কা-যুদ্ধ
মৃধা বাড়ির মস্ত বড় আম গাছটির
মগডালে বাসা বানিয়েছিল নিমাই কাক নামের বড়ই আলসে প্রকৃতির এক কাক। অনান্য কাকদের মত তার এত
সকালে ঘুম থেকে জাগবার অভ্যাস ছিলনা। আলসামো করে সে একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠত। কাকেরা এ নিয়ে প্রায়ই ঠাট্টা তামাশা করত। তবে
নিমাই কাক কখনোই এসবে পাত্তা দিতনা। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে অনান্য কাকেরা যেখানে
চেঁচামেচি শুরু করত, সেটা তার পছন্দ হতনা। সে বরং ঘুমিয়ে অতিরিক্ত আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে
দিত।
একদিন হলো কি, বাইরে অনান্য কাকদের অতিরিক্ত চেঁচামেচি শুনে নিমাই কাকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে হট্টগোলের মধ্যে না যেয়ে অন্য কারো কাছ থেকে খবর পাবে এই আশায় বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকবার পর
সে যখন কাউকেই নাগালের মধ্যে পেলনা তখন বাসা থেকে গলা বাড়িয়ে এদিক ওদিক দেখতে
লাগল। নিমাই কাকের প্রতিবেশী কণ্ঠী কাক। সে প্রতিদিন সকাল বেলায় তার বাচ্চাদের
কা-সংগীত শেখাতে ব্যস্ত থাকত। আজও সে তার নিজের ছানাদুটির সাথে তাল মিলিয়ে গম্ভীর গলায় কর্কশ সুরে “কা-কা, কাও-কাও” বলে গানের সুর তুলছিল। কিন্তু বেজন্মা কোকিলের বাচ্চাটা কিছুতেই গান শিখতে পারছিলনা। কণ্ঠী কাকের মতে, ওর গলাটা ভালোনা, আর অপরিপক্ব। তাই সে যতই তাকে কা-কা বলে গাইতে বলে সে ততই মিহি কণ্ঠে, নাকি সুরে মিষ্টি করে বলে ‘কুহু কুহু’।
অলস নিমাই কাক তার বাসা থেকে মাথাটা সামান্য বের করে কণ্ঠীকে বলল, “ কণ্ঠী তুই গিয়ে দেখে আয়তো কি হয়েছে ওখানে?” কণ্ঠীর মুরুব্বি হওয়াতে সে ‘না’ বলতে পারলনা, সে তার গান শেখানো বাদ রেখেই ছুটল জটলার দিকে। সে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ নিমাই কাক অপেক্ষা করল, কিন্তু কণ্ঠী আসলো না। নিমাই বুঝতে পারলো, সত্যই কিছু একটা হয়েছে। এখন সে না গেলে কাক সমাজে তার মর্যাদা কমে যাবে, তাই সে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
নিমাই কাক ঘুমের ঘোরে কোন রকমে কাক-সভার ঠিক মাঝখানে গিয়ে বসল। হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসায় কাকেরা তার দিকে কটমট করে চেয়ে থাকল। নিমাই চোখ না খুলেই বলল, “ কি হয়েছেরে এইখানে? এত সকাল বেলায় চিৎকার কিসের?”
এত বড় দুঃসংবাদ সে জানেনা, তাই সকলের রাগ হল। সে মুরুব্বি বলে কেউ কিছু বললনা। কাকদের মধ্যে শ্যামল কাক একটু হুজুগে প্রকৃতির ছিল। সে বলেই ফেলল, “ দেখছেননা কি হয়েছে? আপনার মত দিনের বেলায় ঘুমায়ে ঘুমায়ে মাকাল ফল খাওয়ার স্বপ্ন দেখলে কি কাকদের দিন যাইবে?”
শ্যামল কাকের কথায় নিমাই কাকের ঘুম ঘুম ভাব চলে গেল। সে চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল কে এত বড় কথাটা বলল? তাতেই এক সময় তার চোখে মৃত কাকটি পড়ল। নিমাই তাতে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকল। তারপর তার ঘুম ঘুম চোখে কান্না না আসলেও কান্না ভাব করে বলল, “ওরে আমার বন্ধু মতিরে কে মারল?”
শ্যামল কাক: উহু এতক্ষণে আসছে সে বন্ধুর খবর নিতে।
ছোটকু কাক: মতির জানাজা হইবার পথে, আর সে এখন আসছে দরদ দেখাইতে।
নিমাই কাক তাদের কথায় একটু রেগে বলল, “কার এত বড় সাহস যে আমার কাক বন্ধুরে মাইরা ফেলে?”
শ্যামল কাক: কার আবার! ছেদু মিয়ার। কাইলকাই সে আমার বাসায় ঢিল
ছুইড়া আকলীর মায়েরে আধমরা কইরা ফালাইছে, আর আইজ............।
অতি আবেগে শ্যামল কাকের কন্ঠরোধ হল।
নিমাই কাক রাগত স্বরে বলল, “ওরে ছেদু মিয়া জানেনা আমারা কাকেরা ছেদু মিয়ার বাড়ি ঘেরাও করলে সে
তো দুরের কথা, তার চৌদ্দ গুষ্টিও ঘর থাইকা বাহির হইতে পারব না, আর সে আমার বন্ধুরে মাইরা ফেলে!
এবার কাকদের শক্তিমত্তা নিয়ে কথা বলায় মুহূর্তের মধ্যেই সবার মাঝে নিমাই কাকের অবস্থান পরিবর্তন হল। নিমাই এইবার খুব সত্য কথাটি
বলেছে। কাকেরা নিচু গলায় নিমাই কাকের কথায় সায় দিতে থাকল। কিন্তু ছেদু মিয়ার বিরুদ্ধে
চুড়ান্ত যুদ্ধে যাবার আগে কাকদের সর্দার কবি কাকের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইল। কবি কাক চোখ বন্ধ করলেন। বাকি
কাকেরাও নিশ্চুপ। কবি কাকও নিশ্চুপ। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাবার পর কবি কাক
নিরবতা ভাঙ্গলেন। তার স্বভাবসুলভ কবিতা পাঠ না করে বেশ আবেগী ভাষায় বলতে লাগল, “আর
একটা ঢিলও যদি ছেদু মিয়া আমাদের দিকে ছোঁড়ে, তাহলে তার যথাযথ জবাব দিতে আমরা কাকেরা
শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাব। এই গাছ আমাদের, আর আমাদের দখলেই থাকবে”।
এ কথা বলেই বৃদ্ধ কবি কাক মগডালের দিকে ঊড়াল দিল। এদিকে
কাকেরা যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ন প্রস্তুত হয়ে রইল। কিছুক্ষনের মধ্যে তাদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে গেল। দুষ্ট বালক ছেদু
মিয়া মতি কাকের লাশের আস পাশ থেকে কাকদের সরানোর জন্য ঢিল ছুড়তে লাগল। অতর্কিত
হামলায় কাকেরা প্রথমে পিছ-পা হলেও কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আবারো ফিরে এল। কাকেরা
একের পর এক ছোঁ মেরে ছেদু মিয়াকে পেছনে সরিয়ে দিল। ছেদু মিয়া কাকদের অলক্ষ্যে
বাড়ির আড়ালে চলে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যেই তারই বয়সী বেশ কয়েকজন সাঙ্গো পাঙ্গো নিয়ে
হাজির হল। এর পরেই শুরু হল তুমুল কা-যুদ্ধ। ছেদু বাহিনী ঢিল ছোঁড়ে আর কাকেরা ছোঁ
মেরে তাদের ভয় দেখায়। ছেদু বাহিনী দেয়ালের আড়াল থেকে ঢিল ছুড়তে শুরু করায় কাকেরা
আর পেড়ে উঠছিলনা। বেশ কয়েকটি কাক আহত হয়ে গেল।
এদিকে নিমাই কাক যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে কিছু দূরে
সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। ডাকে সারা দিতে ছেদু মিয়া নিমাই কাকেরই কাছাকাছি আসলো। কাজ
শেষ করে ছেদু মিয়া যখন যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে ফিরছিল ঠিক তখনই নিমাই কাক হামলা করল।
ছেদুর মাথার উপড়ে বসে সমস্ত শক্তি দিয়ে বেশ কয়েক বার তাকে কামড়ে দিল। ছেদুর
চিৎকারে আসে পাশের বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করল। আর নিমাই কাক বিজয়ীর বেশে চিৎকার করতে
করতে বলল, “ওরে ছেদু মিয়ার মাথা ছ্যাদা কইরা দিছিরে”।
চলন্তিকা ঈদ
সংখ্যায় প্রকাশিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন