দশ
আরিফকে
আমি বারবার বলেছিলাম, ‘তুই ভিলেজ পলিটিক্স বুঝিস না”। এই
ঘটনা গুলোর পেছনে তোর চাচার হাত আছে। কে শোনে কার
কথা, এতগুলো ব্যপার চাক্ষুষ দেখার পরেও সে কূফরী কালাম
কে তার বাবার মৃত্যুর কারণ হিসেবে মেনে নিতে পারছেনা। কবিরাজ আমাকে পরিষ্কার করে বলেছে ওদের বাড়ির মানুষ এই কাজ করেছে।
আমার মনে হয় ঘটনা ধামাচাপা
দেবার জন্য কবিরাজকেও ওরা খুন করেছে, যদিও গ্রামের লোকজন বলাবলি করছে যে, সেদিন জাদু নষ্ট করতে যাওয়াতে অশুভ সেই শক্তিটা তার এই বেহাল অবস্থা
করেছে। কিন্তু একটা ব্যপারে আমি নিশ্চিত আরিফের চাচারা কালো জাদুতে পারদর্শী নয়। তাদেরকে এ ব্যপারে কে
সাহায্য করতে পারে তা ভাবতেই আমার
মনটা অজানা আতঙ্কে ছেয়ে যাচ্ছে।
তাহলে
কি তপুও বুঝতে পেরেছে কে বা কার
পরিবার এমন কাজের সাথে জড়িত। সেদিন রাতের সেই ঘটনার সাথে এর কী সম্পর্ক?
এগারো
বাবা
মারা যাবার পর থেকেই আমি
ও আমার মা শহীদের বাড়িতে
থাকছিলাম। আমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতে একেবারেই সাহস পাচ্ছিলাম না। গ্রামের অন্যান্য লোকজন প্রকাশ্যে আমদের সাহায্যে আসছিলনা আমার চাচাদের ভয়ে। এখানে থেকেও মা সস্তি পাচ্ছিলেন
না।আমারও ঢাকায় চলে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমাদের গ্রামের লোকজনের সাহায্যের আশায় এখানে আছি। জমির দাবি দাওয়ার ব্যপারে গ্রামের কিছু লোক আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছিল।
ঢাকা
ফিরে আসার আগের দিন সন্ধ্যার পরে বেশ কিছুক্ষণ মাঠের ধারে শহীদের বন্ধুদের সাথে গল্প গুজব করলাম। শহীদের আসার কথা ছিল। কেন আসেনি তা জানিনা। সকাল
থেকেই কেমন মন মরা হয়ে
বসেছিল। ওর বাবার সাথে
একেবারেই কথা বলছিলনা। আমাকেও কিছু বলছিলনা। কি ভেবে গল্পের
আসর থেকে উঠে গিয়ে শহীদের বাড়ির দিকে গেলাম। ওদের বাড়ির সামনে আসতেই শহীদের চিৎকার চেচামাচির আওয়াজ পেলাম। আমি দৌড়ে বাড়ির ভেতরে যেয়ে দেখলাম শহীদকে ওর মা জাপটে
ধরে আছে আর ওর হাতে
বেশ বড় একটা রামদা
উঁচিয়ে ধরা ছিল। আমকে দেখে শহীদের মা হাতের বাধন
শিথিল করতেই শহীদ ঠিক উলটো দিকের দরজা দিয়ে ভোঁ দৌড় দিল। আমিও কিছু না বুঝেই ওর
পিছুপিছু দৌড় দিলাম, পেছন থেকে শুধু ওর মায়ের চিৎকার
শুনলাম “বাবা ওরে ঠেকাও”। আমি ওর
পায়ের আওয়াজের আন্দাজে দৌড়চ্ছিলাম আর চিন্তা করছিলাম
আমার মা ঘরে থাকার
পরেও কেন শহীদকে ঠেকানোর চেষ্টা করছিলোনা কিংবা শহীদের মাকে সাহায্য করছিলোনা।। হাতে রামদা নিয়ে রাগের মাথায় ঘর থেকে বের
হওয়াটা সবসময়ে বিপদের কারণ হতে পারে।
আমি
পেছন থেকে চিৎকার চেঁচামেচি করেও শহীদকে থামাতে পারলামনা, দৌড়েও ওর সাথে পেড়ে
উঠলাম না। ওকে হাড়িয়ে ফেলার পরেও মিনিট খানেক দৌড়লাম। আর তাতেই রাস্তা
হাড়িয়ে ফেললাম। চারদিকে শুধু বাঁশ ঝাড় দেখতে পাচ্ছিলাম। মোবাইলের আলোতেও এখানকার অন্ধকার কাট ছিলনা। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম।
চিৎকার দিয়ে শহীদকে ডাকতে যাব ঠিক তখনই আমার পাশ দিয়ে কিছু একটা ছুটে গেল। আমার বুকটা ধক্ করে উঠল। আমি একটা বাঁশকে শক্ত করে ধরলাম। তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম।
মিনিট
খানেক এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর কিছু লোকের
কথার আওয়াজ পেলাম। আমি তাদেরকে ডাকতে যেয়েও থেমে গেলাম। যারা আমার এই দিকে আসছিল
তাদের মধ্যে থেকে আমার বড় চাচার গলার
আওয়াজ পেলাম। তিনি কাউকে বলছিলেন, ‘আরিফ্যা শয়তানটারে দেখছসনিরে’। পাশ থেকে
কেউ বলল ‘না চাচা, তয়
এইদিকে আসার আওয়াজ আমি পাইছি’। আবছা আলোয়
দেখলাম তাদের তিনজনের হাতেই দেশী অস্ত্র। আমার আর বুঝতে বাকি
রইল না, ওরা সন্ধ্যার পর থেকেই আমাকে
মেরে ফেলার জন্য ফলো করছিল। আমি নিজেই একা হয়ে ওদের কাজটা সহজ করে দিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম তারা যেন এইদিকে না আসে। কিন্তু
আমার চিন্তার বিপরীত হতে লাগল। ওরা আমার দিকে আসতে লাগল।আমি দৌড়ানোর কোন চেষ্টা করলামনা। কারণ তাতে লাভ নেই, চারদিকে বাঁশের শুকনো পাতা পরে আছে। একটু নড়াচড়া করলেই টের পেয়ে যাবে, আর ওরা সংখ্যায়
কতজন তাও আমি জানিনা। আমার কাছ থেকে প্রায় বিশ হাত দুরে তারা, আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। শুকনো পাতার মচ মচ শব্দ
আরও গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। এখনো তারা আমায় দেখতে পায়নি, কিন্তু খুব কাছে আর খুব অল্প
সময়ের মধ্যে হয়তবা ওরা আমাকে পেয়ে যাবে। ঠিক তখনি ওদের মাঝ থেকে কেউ কোন কিছুর সাথে পা বেধে গিয়ে
ধপাস করে পরে গেল। আঘাত পেয়ে সাথে সাথে ‘মাগো’ বলে মাঝারি ধরনের চিৎকার দিল। চিৎকারের সাথে সাথেই চারদিকে যেন হুলুস্থুল বেধে গেল। কি যেন এদিক
ওদিক দৌড়াতে আরম্ভ করল। মাথার উপরের বাঁশ গুলো থেকে অনেকগুলো পাখি একসাথে উড়ে গেল। আমিও সুযোগ বুঝে চুপচাপ একটা গর্তের মত জায়গায় কাত
হয়ে শুয়ে পড়লাম।
বার
তীব্র
শীত আর মাটির ঠাণ্ডায়
শরীর বরফ হবার যোগার, তার সাথে মৃত্যু আতঙ্ক ত আছেই। সে
আতঙ্কে কখনো কখনো সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে। তা আবার ঠাণ্ডা
বাতাসে শরীরকে আরও শীতল করে তুলছে।
কিছুক্ষণ
আগেও আমি ভেবেছিলাম হয়তবা আমার চাচার লোকজন চলে গেছে। কিন্তু আমার ভুল ভাঙ্গল, ওরা আবার ফিরে এসেছে। ভাগ্যিস আমার গাছের উপর থেকে পাখিগুলো চলে যাবার সময় বাঁশের অনেকগুলো শুকনো পাতা ফেলে দিয়ে গেছে। তাতে আমার শরীরটা প্রায় ঢাকা পরেছে। তাতেও যথেষ্ট ছিলনা, যেভাবে আমাকে খোজা হচ্ছে তাতে ধরা পরে যাবার আশংকা ছিল। ভাগ্য ভাল পাখিগুলো আবার ফিরে এসে বাঁশের উপরে বসেছে, তাতে আমার উপরে আরও কিছু পাতা পরেছে।
লোকগুলো
হতাশ হয়ে চলেই যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই আমার পায়ে একটা পিপড়া কামড়ে বসল। আমি সহ্য করতে না পেরে হাত
দিয়ে ওটাকে সরাতেই শুকনো পাতার কড়মড় আওয়াজ হল। তাতেই একজন লোক পেছন ফিরে তাকিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার চলে গেল, কিন্তু আমি আগের মতই চুপচাপ শুয়ে থাকলাম। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। আমি রাস্তা হারিয়ে বসেছি, আবার শহীদ কোথায় গেল কিংবা আমার মায়ের উপরেও ওরা হামলা করবে কিনা তাও চিন্তা করছিলাম। হঠাৎ করেই আমার চিন্তায় ছেদ পরল। মনে হল কেউ যেন
আমাকে ‘আরিফ’ ‘আরিফ’ বলে ফিস ফিসিয়ে ডাকছে। আমার দৃষ্টি যতদূর গেছে তাতে আমি কাউকে খুঁজে পেলামনা। ভয় হল, এবার
আবার কোন বিপদে পরলাম কে যানে।
বেশ
কিছুক্ষণ আর কিছু শুনলামনা।
আমিও একটু নড়েচড়ে বসার চেষ্টা করলাম। তাতে আওয়াজ হল। সাথে সাথেই আবার সেই ডাক শুনতে পেলাম। এবার আরও কাছ থেকে। আমার মনে হল চেনা কেউ
আমাকে ডাকছে। তারপরেও আমি চুপ হয়ে রইলাম। কিন্তু পিপড়াগুলো আমাকে নিঃশব্দে থাকেতে দিলনা। আওয়াজ পেয়ে সেই কণ্ঠস্বরের অগান্তুক আমার দিকে আসতে লাগল। তার পায়ের তলার শুকনো পাতা মাড়িয়ে যাবার আওয়াজ আরও স্পষ্ট হচ্ছিল। আমি আবছা আলোয় দেখতে পেলাম আমার প্রায় সামনে একটা ছায়ামূর্তি আসছে। ঠিক তার পর মূহুর্তে সেটা
আবার দেখলাম না। ভয়ে আমি ঘামতে লাগলাম। মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরে ছায়ামূর্তিটাকে দেখতে পেলাম। এবার সেটা আমার ঠিক দশ হাত দূরে।
আস্তে আস্তে সেটা আমার মাথার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি সেটার পায়ের তলার কাঁচা মাটির গন্ধ পাচ্ছিলাম। তারপরে হঠাৎ করেই ঠিক আমার মাথার উপরে টর্চের আলো পরল। আমি অজানা ভয়ে মাথায় হাত দিয়ে পরর্বতি আঘাত থেকে বাচার চেষ্টা করলাম। আলোতে দেখলাম ওটার পায়ে কাদা আর রক্তের মাখামাখি।
আমি সেটার মুখের দিকে ভয়ে তাকাতে পারছিলামনা। শুধু আঘাতের অপেক্ষায় অল্প অল্প কাঁদতে শুরু করেছিলাম। আমার মাথার উপরে আঘাত পরল বটে কিন্তু সেটা একেবারেই আস্তে। আমি মাথা তুলে তাকাতে যাব ঠিক তখনি সেটা আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল আর গম্ভীর গলায়
বলল, ‘চল আমার সাথে’।
শহীদ
আজ দিয়ে আমায় তৃতীয় বারের মত রক্ষা করল।
ওর হ্মৃণ আমি কখনো শোধ করতে পারবনা। ও এখন আমার
পথ প্রদর্শক, অগত্যা নিশ্চুপে ওর পিছু পিছু
হাটতে লাগলাম। কিন্তু শহীদকে একেবারেই অন্যরকম মনে হচ্ছিল। কোন কথা বলছিলনা। সাবধানতার কারণে এমন করতে পারে তাই ভেবে আমি কিছু বলছিলাম না। হাটতে হাটতে হঠাৎ করেই শহীদ টর্চটা নিভিয়ে দিল। আমিও ওকে আর দেখতে না
পেয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে গেলাম। খুব কাছা কাছি জায়গা থেকে বেশ কিছু মানুষের কথার আওয়াজ পেলাম। আমি হাতরে শহীদকে পাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও আমার নাগালের
বাইরে। কয়েক মূহুর্ত পরেই একটা রোমষ হাত আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। আমি শহীদ ভেবে সাথে সাথে যেতে লাগলাম। তারপর একটা ঝোপের আড়ালে থামলাম। এখান থেকে লোকগুলোর টর্চের আলোতে সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল সাথে নিজেকে আড়াল করার জায়গাও পাওয়া গেছে। কিন্তু শহীদকে আমার নজরে পরলনা। ওখানে লোকগুলো আর কেউ ছিলনা,
আমার চাচা আর তার সাগরেদেরা।
আমার চাচা কাউকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘ঐ বদমাইশ ছোড়াটার
জানে জিগার বন্ধুটার কি করলিরে”।
পাশের কেউ বলল, “গাছের সাথে ঝুলাইয়া রাখছি”। চাচা শুধু
‘হুম’ বলল। আমি কিন্তু বুঝলামনা কাকে নিয়ে এ কথা বলা
হচ্ছে। শহীদ তো আমার সাথেই
আছে। যদিও এখন দেখতে পাচ্ছিনা।
আমি
শহীদের কথা চিন্তা করে অনমনে হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করেই চাচার সাথে থাকা লোকগুলোর মধ্যে হাসির রোল পরে গেল। আমার চাচা হসতে হাসতে বলছিলেন, “সারা জীবন শহরে থাইকা গ্রামে আইসা সম্পত্তির ভাগ নিতে আইছে, শহরের বাঘ গ্রামে যে বিলাই তাতো
হারামজাদায় জানতনা, এক্কেরে বান মাইরা দিছি শেষ কইরা। কোর্ট কাছারিও কেউ করতে পারবনা”। সাথের লোকগুলো
এবার সায় দিতে লাগল। এবার বুঝলাম এগুলো আমার বাবাকে নিয়েই বলা হচ্ছে। আমার প্রচণ্ড রাগ হল। কিন্তু শহীদকে ছাড়া এতগুলো লোকের সাথে পেরে উঠা সম্ভব নয়। চাচা একা হলে আজ ওকে সোজা
উপরে পাঠিয়ে দিতাম। ততক্ষণে ওরা আমার মাকে নিয়ে কখনই সম্ভাবনা এমন কছু ব্যপার নিয়ে অশ্লীল কথা বলতে লাগল, একজন আমার মাকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে বলে হাসতে লাগল। আমি আর নিজেকে সামলাতে
পারলামনা। উঠে দৌড়ে যেতে লাগতেই শহীদ ওর রক্ত মাখা
হাতে রক্তমাখা রামদাটা এগিয়ে দিল। আমি সেটা এক ঝটকায় নিয়ে
আমার চাচার উপর ঝাঁপিয়ে পরলাম। হঠাৎ আক্রমণে লোকগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমার চাচার কাঁধ বরাবর প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে একাধিক রামদায়ের কোপ বসিয়ে দিলাম, তাতে ঘাড়টা একদিকে ঝুলে পরল। তারপর আমার মাকে প্রস্তাব করতে চায় সেই শেয়ালটার মুখ বরাবর দুইটা কোপ বসিয়ে দিলাম। সমস্ত ব্যপারটা মাত্র পনের সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল। তারপর শহীদ আমাকে সামনে থেকে ডেকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি এই দিকে দৌড়ে
আয়”। আমার তাতে
চেতন হল, সাথে সাথেই শহীদের গলার আওয়াজ যেই দিক থেকে হচ্ছিল সেইদিকে দৌড় দিলাম। পেছন থেকে ওদের দুজন লোক আমার শার্ট টেনে ধরল। সামনে থেকে শহীদ আমাকে হ্যাঁচকা টান দিলে আমি ছুটে গেলাম। তারপরে ওর পায়ের আওয়াজ
লক্ষ করে দৌড়াতে লাগলাম।
আমি
শহীদের পেছনে পেছনে দৌড়চ্ছিলাম ঠিকই কিন্তু কোথায় যে যাচ্ছিলাম তা
জানতাম না। অন্যদিকে আমার পেছনে আমার চাচার সেই শেয়ালগুলো দৌড়চ্ছে। আমি শহীদকে ডাকতে থাকলাম, কারণ বেশ কিছুক্ষণ দৌড়ে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু শহীদ থাম ছিলনা। আমিও তাই থামলাম না। মিনিট খানেক এভাবে দৌড়ানোর পর আমি সামনে
থেকে শহীদের পায়ের আওয়াজ আর পাচ্ছিলাম না।
পেছনের আওয়াজও বন্ধ। তার মানে এখন আমি একাই দৌড়চ্ছি। থামব কিনা চিন্তা করছি ঠিক তখনি সামনে থেকে কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে গেলাম। সামনে কিছু আছে তা ধরে উঠতে
যেয়ে বুঝলাম আমি যা ধরে আছি
তা একটা মানুষের পা। কাউকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আমি প্রচণ্ড ভয়ে আরও জোড়ে দৌড়াতে লাগলাম। সামনে ট্রেন চলার আওয়াজ পেলাম।পেছনে খুব কাছ থেকে শহীদ বলল, “ট্রেন ধর, নয়তো মারা পরবি”। আমি পেছনে
ঘুরে কাউকে দেখতে পেলামনা, তবে থামলামও না। ট্রেন ধরার চেষ্টা করতে থাকলাম। ততক্ষণে আমার চাচার লোকেরা আমার পিছু নিয়েছে, তাই আমি আমার শরীরের সব শক্তি দিয়ে
দৌড়ে ট্রেনটা ধরলাম। মাল গাড়ি ছিল তাই একটু আস্তে চলছিল। গাড়ির পেছনের বগির একটা ওয়ার্কার আমকে টেনে তুলল। পেছনের লোকগুলো আমাকে ধাওয়া করছিল, সে তা দেখতে
পেয়েছে। আমার চাচার শেয়ালগুলো আর বেশি দুর
আসলনা। ট্রেনটা শহীদের বাড়ির পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। ট্রেন থামানো সম্ভব ছিলনা তাই নামতেও পারলামনা। আমি শহীদের বাড়ির সামনে লোকজনের জটলা দেখে চিন্তিত হলাম। কি হতে পারে?
ওয়ার্কার
ছেলেটার সাহায্য নিয়ে ট্রেনের গতি কমালাম। ততক্ষণে ফজরের আজান হয়েছে। একটা লোককে সামনে পেয়ে কি হয়েছে তা
জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল যে,
কানাই কবিরাজ কূফরী করার জন্য শেয়াল মারতে গিয়ে নিজেই মারা পরেছে। এই কানাই কবিরাজই
শহীদের বাবা। এতক্ষণে আমি বুঝলাম কেন শহীদ ওর বাবার পেশাটাকে
অপছন্দ করত। কিন্তু এত বিপদজনক লোকটাকে
মারলইবা কে? শহীদ নয়ত আবার! আমার সামনেই ও সেদিন ওর
বাবাকে মারতে যেতে উদ্যত হয়েছিল। তবে কি আমার মা
কাল রাতে জানতে পেরেছিল শহীদের বাবাই আমার বাবাকে মারার জন্য চাচার পক্ষের মূল কারিগর। তাই শহীদ ওর বাবাকে মারতে
যেতে উদ্যত হলে, আমার মা ওকে ঠেকায়নি
কিংবা ওর মাকে সাহায্য
করেনি। শহীদকে পাওয়া গেলেই সব প্রশ্নের উত্তর
পাওয়া যাবে।
তের
ট্রেনটা
পুরোপুরি থামলে আমি দুজন লোকের সাথে সাথে শহীদের বাড়ির দিকে চললাম। তখন চারদিকে বেশ আলো ফুটেছে। আমি এখন একটু হলেও নিরাপদ। আমার মাকে আমি একা রেখে চলে যেতে পারিনা। যেভাবেই হোক তাঁকে আমার সাথে নিয়ে যেতে হবে।
শহীদের
বাড়ির সামনে আসলে লোকজনের জটলা দুটিভাগে বিভক্ত দেখলাম। প্রথমকার জটলায় দেখলাম শহীদের বাবাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। লোকজন নানা মন্তব্য করছে। কাঁধের পাশে একটা দা এর আঘাত
দেখতে পেলাম। শহীদের মা নিথর ভাবে
লাশের পাশে বসে বসে কাঁদছে। তার চোখে কোন জিজ্ঞাসা নেই। এই পরিণতির জন্য
তিনি কাকে দোষারোপ করবে, আমাকে না শহীদকে? আমার
দিকে একবার তিনি চেয়ে ঘৃণায় চোখ নামিয়ে নিয়ে আনলেন। আমারও ভালো লাগলনা।
আমার
মাকে দেখতে না পেয়ে পাশের
জটলায় গেলাম। আমার মা এখানে বসে
বসে নিশ্চুপে কাঁদছেন। যেয়ে উঁকি দিয়ে লাশের দিকে তাকাতেই আমার চক্ষু স্থির হয়ে এলো। এ আর কারো
লাশ নয়, আমার বন্ধু শহীদের লাশ, গলা ও হাতে এখনো
দড়ি দিয়ে বাধা। আমিও কান্নায় ভেঙে পরলাম। আমার জন্যই শহীদ মারা পরল। আমি একবারও ভেবে দেখলাম না আমার চাচার
লোকেরা যাকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছে সে শহীদ। আমার
জানে জিগার দোস্ত সে ছাড়া আর
কেউ নয়। সেখানে আমাকে ছাড়া আর কারও সম্পর্কে
কিছু বলা হচ্ছেনা। কিন্তু আমাকে ‘কে’ খুঁজে বের করে ট্রেন পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। সে কি তবে
শহীদ নয়? আমি তাকে দেখেছিলাম কিন্তু কখনই স্পষ্ট দেখতে পাইনি। সেই মূর্তিটা শহীদের ছাড়া আর কারও হতে
পারেনা। আমার চাচার লোকের ভাষ্য মতে চাচাকে আমি মারার আগেই তাঁকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে কে আমাকে রামদা
এগিয়ে দিয়েছিল? কার পিছু পিছু আমি দৌড়ে এসে ট্রেন ধরলাম? আমি যে ঝুলন্ত লাশের
পা ধরে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম সেটাই কি শহীদ? আর
যে আমাকে সাহায্য করছিল সেটা কি শহীদের আত্মা?
যে শহীদের ঝুলন্ত লাশ পর্যন্ত আসতে পেরেছিল তার পরে আর পারেনি, কিন্তু
আমাকে শেষ উপকার হিসেবে ট্রেন ধরার কথা বলতে ভুলেনি। তাহলে কি শহীদের লাশ
পর্যন্ত আমি আসার পরেও সে বেঁচেছিল? আর
ওর আত্মাটা আমাকে সেখানে নিয়ে এসেছিল ওকে বাঁচাবার জন্যই। তা ভেবে আমি
হাঊমাঊ করে কেঁদে উঠলাম। আমি কেন এবং কিভাবে এত স্বার্থপর হলাম।
একবারও ভেবে দেখলাম না সেটা শহীদ
হতে পারে। আমার জন্য যে নিজের বাবাকে
হত্যা করল নিজের জীবন বাজি রেখে, সেই কিনা এমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাছে
ঝুলে থেকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে মারা গেল। আর আমি স্বার্থপরের
মত নিজের জীবন বাঁচাতে দৌড়ে পালালাম। ওকে একবারও বাঁচানোর কথা চিন্তা করলাম না। আমি শহীদের মায়ের মত সহজ সরল
মানুষের জন্য যে কান্না বয়ে
নিয়ে এসে ছিলাম সেই কান্না কি কখন কি
কখনো থামবার?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন