This blog is about Bangle Ghost, Horror, Funny and fantasy story.

This blog is about Bangle Ghost, Horror, Funny and fantasy story.

টুনটুনির প্রেম

এক

জমিদার ঈশা খাঁর প্রাসাদের বাগানে টুনটুনি পাখিদের আড্ডা ছিল। সারাদিনই টুনটুনি পাখিরা এদিক
সেদিক নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত। বাগানের ছোট্ট ডুমুর গাছটিতে বাসা বেধেছিল মুকুল টোনার বাবা-মা। মুকুল টোনার জোড়া টুনটুনি পাখিটা অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিল। তাই সে ছিল একা। তার চোখ দুটি সব সময় একটা টুনির খোজে এদিক সেদিক চেয়ে দেখত। কিন্তু প্রতিদিনই সে ব্যর্থ হত। এদিকে তার মা-বাবা নতুন একজোড়া ডিম নিয়ে ব্যস্ত, তার দিকে ফিরে তাকাবারও সময় নেই তাদের। সুতরাং তার সময় এসেছে নিজের জীবনটা নিজেই বুঝে নেবার।

প্রতিদিনের মত আজও মুকুল টোনা একটা টুনির খোজে বসেছিল। কিন্তু সেই একই ঘটনা, প্রতিদিনের
মত তাকে আজও একাই বসে থাকতে হল। তবে আজ কপাল মন্দ ছিলনা। ডুমুর গাছের নিচে বেগুন গাছে একটা ছোট ঘাস ফড়িং দেখে তার চোখ চক চক করে উঠল। তার খিধেও পেয়েছিল প্রচুর। সাথে সাথে সেপোকা খাওয়ার জন্য নিচে উড়াল দিল। কিন্তু তার ঠোঁটে পোকাটি ধরা দিলেও অন্য একটি পাখির সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পরে গেল। কারণ একটা টুনি ঠিক একই ঘাস ফড়িং লক্ষ্য করে অনেকক্ষণ ধরে বেগুন গাছেই বসে ছিল। একই সাথে দুজনে শিকার ধরতে যাওয়ায় ধাক্কা খাওয়া। অন্য দিন মুকুল টোনা এরকম অপ্রত্যাশিত ধাক্কা খেলে ঝগড়া বাধিয়ে দিত, কিন্তু আজ যে কি হল, সে টুনিকে কিছু বলা বাদ দিয়ে তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে থাকল। কিন্তু নীল টুনির মুকুল টোনাকে দেখে অবাক হবার কিছুই ছিলনা। শিকার হাড়িয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে বলল, “অ্যাঁই আপনি কেমন টোনা, একটা টুনির খাবার
কেড়ে খান”?

সুপ্ত টুনির কথায় মুকুল টোনার হুঁশ ফিরে এলো। সে স্বপ্নের জগত থেকে বাস্তবে আছার
খেল। টুনির কথা শুনে তার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। সে একবার মনে করল টুনিকে তার শিকার ফিরিয়ে দিবে, কিন্তু কপাল মন্দ খিদের তাড়নায় ততোক্ষণে সেটা কখন যে পেটে চালান হয়ে গেছে তা সে বলতেই পারবেনা। মুকুলের মনটা কেমন ছট্ ফট্ করতে লাগল, টুনির কথা শুনে নয় বরং একটা সুন্দরী টুনিকে বাগে পেয়েও তার মন জোগাতে পারলনা। সুপ্ত টুনি নিজের কথার উত্তর না পেয়ে আরও রেগে গেল, ভাবল এই টোনাটা তাকে অবজ্ঞা করছে। তাই রেগে যেয়ে বলল, “অ্যাঁই আপনি কি আমার কথা শুনতে পান নাই? আমার শিকার খাইয়ে এখন ভান ধরছেন? থামেন আজই আমি কর্তার কাছে বিচার দিতেছি।” মুকুল টোনা কিছু বলতে চাইল কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হলনা। ততোক্ষণে নীল টুনি উড়াল দিয়েছে। তার এলে দুলে যাওয়া দেখে মুকুল টোনা আবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেল।

দুই
সকাল বেলায় মুকুল টোনার বাড়িতে কে যেন ডাকা ডাকি শুরু করেছে। সে ঘুম ঘুম চোখে বাইরে আসতেই শিমুল টোনা তার দিকে এগিয়ে আসে বলল, “এই যে সাহেব, কর্তা আপনাকে বেধে নিয়ে যেতে বলেছে। দিন দুপুরে বেগানা টুনির গায়ে হাত দেন”। মুকুল টোনা এ কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। সেই টুনিটা বুঝি সত্যি কর্তার কাছে গিয়ে নালিশ করেছে।

কর্তা ডেকেছে শুনে মুকুল টোনা কর্তার বাড়ির দিকে ছুটল। পেছেনে তিন তিনটে টুনটুনি পাহাড়ায়। সে ভাবল সত্যিই আজ কিছু হতে যাচ্ছে। সেখানে যেয়ে দেখল জামরুল গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকটা টুনটুনি বসে আছে।

এদিকে আসলে কিছুই হয়নি। শিমুল টোনা সুপ্ত টুনির সম্ভাব্য জোড়া, তাই সে গত দিনের ঘটনার এত
বড় রটনা করেছে। মামলা গভীর করার জন্য তার এই প্রচেষ্টা। কর্তা তপু টোনা সবার মাঝে চুপচাপ
বসে আছে। তাঁর মাথায় অনেক বুদ্ধি, যাকে বলে বুদ্ধির ঢেঁকি। মুকুল টোনা তাঁর কাছে এসে জবুথুবু হয়ে বসতেই সুপ্ত টুনি মুখ ভেংচিয়ে বলে উঠল, “উঁহু সে আইছে, সারাদিন ঘরে ঘুমায়, নিজের খাবার জোগাড় করতে পারেনা আর শুধু অন্যেরটা ছিনায়ে খায়”।

শিমুল টোনা: জী কর্তা, টুনি ঠিক কথাই বলেছে, দিন দুপুরে যার তার গায়ে ছোঁয়ার অভ্যাস তার আগে
থেকেই”।
সুপ্ত টুনি: আমারে বললেই হইত, আমি তার জন্য খাবার ছেড়ে দিতাম।
মুকুলের প্রতি সুপ্ত টুনির এমন আকর্ষণ দেখে শিমুল টোনা কথা নিজের দিকে নিয়ে বলল, “কর্তা,
টুনিকে অন্যায় ভাবে ছোঁয়ার অপরাধে তার শাস্তি হওয়া দরকার”।
হুজুগে বলাই টোনা বলে উঠল, “ জী কর্তা, সে আমার টুনির দিকেও কেমন করে তাকায়, তাকে দল ছাড়া করে দেন”।
মুকুল টোনা এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেও এইবার এর প্রতিবাদে বলল, “কর্তা আমি নির্দোষ, আমি
কিছুই দেখে করিনি”।
এতক্ষণ ধরে কর্তা তপু টোনা সকলের কথাই শুনছিলেন। এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন। সবাই বুঝল
মামলার রায় হতে চলেছে। তপু টোনা চোখ বন্ধ করেই কাব্যিক ভাষায় বলতে লাগল,

“যা হবার হয়েছে
মুকুল না হয় পাপ করেছে।
সে কি টুনটুনির জাত মেরেছে?
অকারণেই গোল বেধেছে”।

সবাই বুঝল এ মামলার রায় হবেনা। কর্তার মন খারাপ কারণ তাদের জমিদারের সাথে ভিনদেশের রাজার যুদ্ধ বেধেছে। তাই আজ সকালে কবি কাক ও ছোটকু কাক এসেছিল যুদ্ধে টুনটুনিদের সাহায্য চাইবার জন্য। কাকেরা অনেকেই যুদ্ধে মারা গেছে কিন্তু টুনটুনিরা নিশ্চিন্তে বসে আছে। কর্তা অপু টোনা সবাইকে ব্যাপারটা খুলে বললেন। তাদেরও কাক পাখিদের সাথে যুদ্ধে যাওয়া দরকার। শিমুল টোনা এতক্ষণ নিজের ভুল বুঝতে পেড়ে পাতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। নতুন একটা কাজ আরম্ভ হবে বলে উৎসাহ নিয়ে সবার মাঝে এসে বসল। ভাবল এইতো সুযোগ সুপ্ত টুনির কাছে নায়ক সাজবার। সে আগ বাড়িয়ে বলল, “টুনটুনি পাখিরা ছোট হলেও দুর্বল নয়, ঝগড়াটে কাকেরা যুদ্ধে যেতে পারলে আমরা কেন পারবনা? আমরাও তাদের মত দেশের জন্য যুদ্ধ করতে জানি তা এবার পাখি সমাজ জানুক”।
হুজুগে বলাই টোনা সাথে সাথেই বলে উঠল, “কর্তা আমি যাব যুদ্ধে”।
সাথে সাথেই সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। হুজুগে বলাই কাক কর্তা তপু কাকের লেখা
যুদ্ধের সে রণ সঙ্গীত পরিবেশন করতে লাগল।

“চলরে ও ভাই টুনটুনি,
দেশের জন্য হতে খুনি
বাঁচি কি মরি না-জানি,
নিজেদের জয় হবে জানি।
ওরে ও ভাই টুনটুনি,
জীবনতো হল একটুখানি
মরতে হবে সবাই জানি
মরার মত মরতে পারে কয়জনি।
চলরে ও ভাই টুনটুনি।”

রণ সঙ্গীত শেষ হবার পর তপু টোনা সবাইকে বুঝিয়ে বললেন তারা আকারে ছোট হওয়ায় সরাসরি যুদ্ধে যেতে পারবেনা। তাই তারা কাকদের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করবে। কথা মত অনেক কষ্টে টুনটুনি পাখিরা যুদ্ধের ময়দানে গেল। সেখানে কাকেরা আকারে বড় হওয়ায় কিছুতেই একটা তাবুতে যেতে পারছিলনা। কিন্তু সেখানেই মানসিংহের সেনাপতিরা যুদ্ধ নিয়ে শলা পরামর্শ করত। তাই শিমুল টোনাই এই কাজের জন্য নিযুক্ত হল। যাবার আগে নীল টুনির দিকে আড় চোখে চেয়ে দেখল। তারপর একটা একটা করে গাছ পেরিয়ে তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করল। মুকুল টোনা তাঁর পিছু পিছু সংবাদ বাহক হিসেবে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ভেতর থেকে সংবাদ দেওয়া হল। মুকুল টোনা তা নিয়ে আসতে গিয়ে দেখল সৈন্যদের হুলু বেড়াল তাঁকে তাড়া করছে। তাই সে চুপচাপ লুকিয়ে গেল। ততোক্ষণে টুনটুনিরা ভয়ে অস্থির। না জানি মুকুল মারা পরে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে মুকুলকে ফিরে আসতে দেখে সবার মন থেকে কালো মেঘ সরে গেল। হুলু বিড়ালের সাথে জিতে আসায় সুপ্ত টুনির আনন্দ কে দেখে। যখন সে বুঝতে পারল সে মুকুল টোনার জন্য আনন্দ করছে তখন লজ্জায় একপাশে সরে গেল। কিন্তু বুদ্ধিমান তপু টোনা একেবারেই নিশ্চুপ ছিল।

কারণ মুকুল আসলেও শিমুল তখনো আসেনি।

কিছুক্ষণ পরেই সেই হুলু বেড়ালটা মুখ ভর্তি টুনটুনি পাখির পাখা নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসল। তারপর
কারোই বুঝতে বাকি থাকলনা শিমুলকে এতক্ষণে হুলু বেড়ালটা ছিঁড়ে কলিজা বের করে খেয়ে ফেলেছে।
তারপর টুনটুনি পাখিদের অবস্থা এমন হল যেন তাদের মুখের ক্ষণিকের সূর্যের হাসি মেঘের কান্নায়
ভেসে গেল।

তিন
পরদিন শীতের সকালের আলো ফুটতেই টুনটুনি পাখিদের নতুন করে জীবন শুরু হল। সুপ্ত টুনি চুপ করে একাকী বসেছিল। মুকুল টোনা তার কাছে এসে বসল। কিছুক্ষণ বসে থাকবার পরেও যখন নীল টুনি কিছুইবলছিলনা তখন সে প্রথম নীরবতা ভাঙলো, “আজ অনেক গরম পরেছে তাই না?”

সুপ্ত টুনি একটু হেসে মুখ ফিরিয়ে নিলো, তারপর বলল, “ইশ্ ঘাস ফড়িংটা কত সুন্দর”। সাথে সাথেই
মুকুল টোনা ঘাস ফড়িংটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
Share:

পিঁপড়া বিদ্যা


পট্ট চার বছর বয়সী ছোট্ট একটি ছেলের নাম। মাস কয়েক আগেই সে বুঝতে শিখেছে কিভাবে তার চারপাশের প্রাণী কিংবা বস্তুর সাথে খেলা করতে হয়। বাসায় তার সাথে খেলবার মত বাচ্চা বয়সী কেউ নেই। তার উপরে প্রায় প্রতিদিনই তার বাবা মা ঝগড়া করে। বাবা প্রায়ই মাকে ধরে পেটা। তাই এই সময়টাকে পট্ট ভয় পেত। প্রথম প্রথম সে মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করত। তার আবদার কাজেও দিত। কিন্তু এখন আর সে আবদারে কোন কাজ হয়না। কারণ বাবা আগের মত তাকে আর ভালবাসে না।  তাই সে এই বিরক্তিকর সময়টুকু বারান্দায় বসে কাটাতো। কিন্তু সময় কাটাতে কিছু একটা তো করা চাই। তার কিছু করার প্রচেষ্টা থেকে সে নিজের অজান্তেই বেশ কিছু খেলা আবিষ্কার করে ফেলেছিল। এই যেমন বারান্দায় উড়ে এসে বসা ছোট ছোট ঘাস ফড়িং এর পেছনে ছোটা, মাছি আটকানো, পিঁপড়ের সাথে খেলা করা ইত্যাদি।

 প্রায় দিনগুলোর মত সেদিনো তার বাবা মায়ের ঝগড়া হচ্ছিল। আর অন্যদিকে পট্ট সময় কাটাতে  পিঁপড়েদের সাথে মজেছিল। পট্ট নিজেও জানতোনা, যে পিঁপড়েগুলোর সাথে সে খেলা করছিল সে পিঁপড়েগুলোর তার মতই সুন্দর সুন্দর নাম আছে। ওর আসেপাশে যে পিঁপড়েগুলো ছিল তারা নিজেরা নিজেদের শিবু পিঁপড়া, কানাই পিঁপড়া, আদল পিঁপড়া নামে ডাকত। সে সময় ছিল প্রায় শীতকাল। পিঁপড়েদের খাদ্য যোগাড়ে লেগে যেতে হত যখন তখনই। কিন্তু দালান বাড়িতে খাবার যোগাড় করা কষ্টের ব্যপার। এখানে পোকামাকড় খুব একটা পাওয়া যায়না বললেই চলে। খাবারের আশায় মানুষের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। আজ শিবু, কানাই আর আদল নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছিল। কারন তাদের নাকে খাবারের গন্ধ আসছিল। কিন্তু সে খাবার তাদের নাগালের বাইরে। তাদের পাশে বসে থাকা মস্ত বড় মানুষ দৈত্যটির হাতেই খাবার। সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে অপেক্ষার পালা শেষ হল। পট্টর হাত থেকে সামান্য খাবার নিচে পড়ল। পিঁপড়েদের কাছে সেটা সামান্য ছিলনা। তাদের কাছে পাহাড়সম মনে হল সেটুকু খাবারকে। তিন জনে অনেক কষ্ট করেও এক চুলও নড়াতে পারলনা। অগ্যতা সলাপরামর্শ করে কানাই পিঁপড়েকে বাসায় পাঠানো হল অন্যদের ডেকে আনবার জন্য। 



পট্ট লক্ষ্য করল সামান্য সময়ের মধ্যেই বেশ কিছু পিঁপড়া সেখানে হাজির হল। খেলা জমে গেছে তাই সে খাবারের অংশটা সেখান থেকে সরালো না। প্রথমে পিঁপড়ারা একযোগে সে খাবারটা তাদের বাসার কাছে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। সামান্য সময়ের মধ্যেই তারা বাসার প্রায় কাছাকাছি খাবার নিয়ে আসল। এবার ভেতরে ঢুকবার পালা। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল পট্ট। তার খেলা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে সে আবার খাবারটা টেনে নিজের কাছে নিয়ে এল। পিঁপড়েরা খুঁজতে খুঁজতে আবার সেই খাবার পেয়ে গেল।  খাবার পেয়েই আবার নিজেদের লক্ষ্যে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টা। তবে এমন প্রচেষ্টা তাদের বেশ কয়েক বারই করতে হল। কারণ পট্ট বেশ বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। শিবু, কানাই আর আদল বেশ রাগান্বিত এই কারণে। কিন্তু পট্ট তাদের কষ্ট বুঝবে কেন। সে তো বেশ আনন্দই পাচ্ছে। এমন নিরানন্দ সময়ে আনন্দের মাধ্যম হয়ে এসেছে পিঁপড়েরা।

 বেশ কয়েকবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর পিঁপড়েরা নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করল। এবারে তারা খাবারটিকে বেশ কয়েক ভাগে ভাগ করে নিজেরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে নিজেদের বাসার দিকে যেতে থাকল। সে এক দলকে থামায় তো আরেক দল খবার নিয়ে বাসার ভেতরে চলে যায়। এ অবস্থা দেখে পট্ট বেশ বিচলিত হয়ে পড়ল।  কয়েক টুকরো খাবার ভেতরে চলে যাবার পর পট্ট বুঝতে পাড়ল এরা তার সাথে চালাকি করছে। সে সেটা বোঝা মাত্রই পিঁপড়েদের বাসার মুখের উপরে হাত দিয়ে পুরো মুখটাই বন্ধ করে দিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সে সময়তেই শিবু, আদল আর কানাই পিঁপড়া নিজেদের অংশ নিয়ে ভেতরে ঢুকছিল। পট্টের হাতের তলায় শিবুর শরীরের অর্ধেক চাপা পড়েছে। সে চিৎকার করছে। কিন্তু তার কান্নার আওয়াজ পট্টের কানে পৌছুচ্ছিল না। আদল আর কানাইয়েরও ভেতরে যাবার দরজা বন্ধ। সাথী পিঁপড়া মারা যায় যায় অবস্থা। কি করবে এখন তারা? দুজনে পরামর্শ করে সেটার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড। কানাই আর আদল পিঁপড়া নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে কামড়ে ধরল পট্টর হাতটিতে। হঠাৎ এমন কামড় খেয়ে পট্ট তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে ফেলল। আর শিবু মুক্তি পেতেই ওর দল খাবার নিয়ে ভেতরে চলে গেল। কিন্তু পিঁপড়ের কামড় খেয়ে পট্ট আর সহ্য করতে পারছিলনা। সে কাঁদতে কাঁদতে বাবা মায়ের কাছে গেল। কিন্তু তার কথা যে শোনার ছিল সে ততক্ষণে অসম যুদ্ধে ধরাশায়ী। পট্টের বাবা তাকে মারবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। তার মা মারের ভয়ে আগেই চিৎকার শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু সে চিৎকার পট্টের বাবার কানে পৌছাচ্ছিলনা। পট্ট কি করবে এখন? সেও পিঁপড়েদের মত কয়েক সেকেন্ড সময় নিল সিদ্ধান্ত নিতে। পিঁপড়া বিদ্যা কাজে লাগিয়ে সে তার বাবার হাতে প্রচণ্ড কামড় বসাল। হঠাৎ কামড় খেয়ে পট্টের বাবা বেশ চমকে গেল। যখন বুঝতে পাড়ল এই কাজ পট্ট করেছে, তখন তার সমস্ত রাগ যেয়ে পড়ল পট্টের উপড়ে। পট্টও তার বাবার অগ্নি মূর্তি দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেল। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে তার হাত দুটো দেখিয়ে বলল, “আব্বু, বারান্দার পিঁপড়েরা আমার হাতে কামড়ে দিয়েছে”। এতেই রাগ কমল বদমেজাজী লোকটার। আর পিঁপড়া বিদ্যার জোরে মুক্তি মিলল অসহায় মেয়ে মানুষটির।     


Share:

পুতুল ও মেছোবাঘের গল্প

এক
পুকুর পাড়ের বাবলা গাছটির পাতাগুলোর মাঝখান দিয়ে শেষ বিকেলের লাল সূর্যটা আবছা দেখা যায়। সেখানে বৃষ্টি ভেজা গাছের পাতাগুলো নিশ্চুপ হয়ে আছে। গাছের নিচে কচু পাতার মাঝে জমে থাকা পানি তখনো মাটি ছোঁয়ার স্বপ্নে বিভোর। শেষ বিকেলের আলো পাতার মাঝে জমে থাকা পানিকে লাল রঙের আভা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই পুতুল প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্যকে আর অবাক চোখে চেয়ে দেখতে পারবেনা। কেননা আর একটু পরেই সন্ধ্যা তার নতুন রূপ নিয়ে পুতুলের সামনে এসে হাজির হবে। কিন্তু সন্ধ্যার এই রূপ পুতুলের মত পাঁচ কিংবা ছয় বছরের একটি মেয়ের কাছে শুধুই অন্ধকার, যে অন্ধকারকে সে ভয় পায়।

প্রতিদিন বিকেল বেলায় সন্ধ্যা না নামতেই সে তার ছোট্ট ভাইটিকে ডেকে ডেকে ঘরে ঢুকায়। কিন্তু আজ বাবলা গাছের ডালে বাঁধা সেই দোলনাটা খালি পরে আছে। মৃদু বাতাসের বেগে বার বার দোল খাচ্ছে। মেঘের কান্না দোলনার ছোট্ট কাঠের তক্তাটা একেবারেই ভিজিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু যে এই দোলনায় দোল খেত সে মহাকালের অজানা পথে হাড়িয়ে গেছে। তাই ছোট্ট ভাইকে না পেয়ে পুতুলের মন খারাপ। প্রতিদিনই তার মা তাকে সান্ত্বনা দেয় যে তার লক্ষ্মী সেই ভাইটি আবার এসে তার সাথে খেলা করবে। কিন্তু তা যে আর কখনোই সম্ভব না সেটাতো পুতুল বোঝেনা।

সূর্য পুতুলকে এতোটুকুও ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। সে তার সঠিক নিয়মেই পুতুলের ছোট্ট ভাইটিকে খুজে পাবার সুযোগ না দিয়েই অস্ত যায়। পুতুলের এ্যাবনরমাল ফুপুটা অজানা ভাষায় আওয়াজ তুলে ওকে ঘরে আসতে ডাকে। পুতুল তার ডাকে সারা দেয়।

পুতুল পুকুর পার থেকে ফিরে আসলেও পুতুলের বাবা, ওর মায়ের তাড়নায় পুকুর পাড়ে যায় বল্লম হাতে করে। গত কয়েকদিন ধরেই এই এলাকায় মেছো বাঘের আনাগোনা। পুতুলের মায়ের ভাষ্যমতে তাদের পুকুরের মাছ এই বাঘগুলোর পেটেই যাচ্ছে। গ্রামের অনেকেই মাছ রক্ষায় পাহাড়া বসিয়েছে। পুতুলের বাবা বাঘ মারতে যাওয়ায় পুতুলের অবুঝ মন আনন্দে নেচে উঠে। 

দুই
সুন্দরবন ঘেরা পুতুলদের এই গ্রামটিতে যেখানে রাত আটটা বাজতেই সবাই ঘুমিয়ে পরে, সেখানে আজ রাত দশটাতেও পুতুলদের বাড়িতে লোকজনের জটলা। সবাই পুতুলের বাবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ কারণ ওর বাবা আজ এই গ্রামে প্রথম এয়াকাই একটা  মেছোবাঘ মেরেছে। পুতুলের প্রথম খুব আনন্দ হলেও বাঘটির ক্ষুধার তাড়নায় একটু খাবারের আকুতি মেশানো মায়া ভরা চোখ দুটি দেখে তার মায়া হয়। তাই সে সবার সাথে আনন্দ না করে মন খারাপ করে ঘুমিয়ে পরে।

পরদিন সকালটা তার খুব খারাপ কাটেতার বাবা সেই মাদী মেছোবাঘটিকে টেনে হেঁচড়ে পাশের ঝোপে ফেলে দিয়ে আসে। পুতুলের সেটা ভাল লাগেনা। সে মুখ গোমরা করে তার পুতুল খেলার ছোট্ট ঘরটিতে চুপচাপ বসে থাকে। কিছুক্ষন বসে থাকার পর তার মা তাকে খাবার জন্য ডাকে। সে কোন উত্তর দেয়না। তার মা তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। পুতুলের মা চলে যাবার পরেই সে তার খুব কাছাকাছি জায়গা থেকে বিড়ালের মিউ মিউ ডাক শুনতে পায়। কিন্তু এই ডাকটা বিড়ালের ডাক থেকে একটু কর্কশ। পুতুল এদিক ওদিক চেয়ে বিড়ালকে খুজে পায়না। ঘর থেকে বাইরে এসে সে খুজে পায় ডাকটি কোথা থেকে আসছে। তার বাবা মেছো বাঘটিকে যেখানে ফেলেছিল ঠিক সেই জায়গা থেকেই আওয়াজ আসছে। পুতুলের মনটা আনন্দে নেচে উঠে, সে ভাবে তার বাবার বেধোরক পেটুনির পরেও হয়ত বাঘটি বেঁচে গেছে। আবার ভাবে বাঘ কি বিড়ালের মত ডাকে! পুতুল উৎসাহ না ঠেকাতে পেরে সেখানে যায়। পা টিপে টিপে ঝোপের এক পাশ ফাকা করে সে দেখে সত্যিই সে বাঘটি মিউ মিউ করে ডাকছে। কিন্তু এ বাঘটা এত ছোট কেন সে তা বোঝেনা। একটুখেয়াল করে দেখে ছোট এই বাঘটির পাশে তার বাবার মেরে ফেলা বাঘটি পরে আছে। পুতুল বুঝতে পারে ছোটটি হয়ত বড়টির বাচ্চা। পুতুল মায়ের জাত, তার এই বাঘ শাবকটির প্রতি মায়া জম্মাতে একটুকূও সময় লাগেনা।

একেবারেই দুধের বাচ্চা হওয়ায় এটি প্রায় বিড়ালের মত দেখতে। পুতুল একবার মনে করে দৌড়ে যেয়ে সে তার বাবাকে এ খবরটা দেবেযেতে যেতে আবার চিন্তা করে তার বাবা যদি এই বাঘটিকেও মেরে ফেলে। তাই ফিরে আসে। আর বাঘটির দিকে দুই হাত বাড়িয়ে বলে, “ ম্যাও, এই দিকে আয়, আমি আমার আব্বুর মত দুষ্ট না। সত্যি তোকে মারবনা”। বাঘটি আরও ভয় পেয়ে পিছনে সরে যায়। কিন্তু পুতুল জানে কিভাবে বিড়াল বশ করতে হয়। সে দৌড়ে বাড়িতে যেয়ে খাবার নিয়ে আসে। এসে দেখে বাঘটি তার মায়ের স্তনে মুখ দিয়ে আছে, কয়েক সেকেন্ড পরেই মায়ের বুকের দুধ না পেয়ে সে তার মাথা তুলে মিউ মিউ করে ডাকতে থাকে। পুতুল ভাবে এ বাঘের বাচ্চাটিও তার হাড়িয়ে যাওয়া ছোট্ট ভাইটির মত দুষ্টু আর একেবারেই লজ্জা নেই। খালি খালি মায়ের বুকের দুধ খেতে চায়।       
  
পুতুল তার হাতের খাবারটা বাঘ শাবকটির দিকে ছুড়ে মারে, বাঘটি ভয় পেয়ে পেছনে সরে যায়। পুতুল মনে করে সে বুঝি এই খাবার গুলো পছন্দ করেনি। তাই দৌড়ে বাড়িতে যেয়ে ভাইয়াকে খাওয়ানো ছোট ফিটারটা দিয়ে অল্প দুধ নিয়ে আসে। এসে দেখে বাঘ শাবকটি ঝোপের বাইরে বেড়িয়ে এসেছে। পুতুল মনে করে, খাবারগুলো শেষ করেই সে এখানে এসেছে। পুতুলের উৎসাহ দিগুণ হয়ে। সে তার ফিটারটি এগিয়ে ধরে তার হাড়িয়ে যাওয়া ছোট ভাইটির নাম ধরে বাঘটিকে ডাকতে থাকে, “শান্ত…… শান্ত...... এই দিকে আয়, দুদু খেয়ে যা”। পুতুল যত সামনে এগোয় শান্ত তত পিছনে যায়। কিন্তু গত দুই দিনের না খাওয়া দুর্বল এই মেছোবাঘ শাবকটি পুতুলের কাছে কিছুক্ষনের মধ্যেই ধরা দেয়। পুতুল জোর করে সেটির মুখে ফিটারটি গুজে দেয়। প্রথমে বেশ কিছুক্ষন ছুটে পালাবার জন্য পুতুলের সাথে ধস্তাধস্তি করে হয়রান হলে সেটি ঠান্ডা হয়। তারপর আশ্চর্য হলেও সত্যি, সে মেছোবাঘ শাবকটি চুক্ চুক্ করে শব্দ করে ফিটারের সবটুকু দুধই সাবাড় করে। পুতুলের আনন্দ আর ধরেনা। তার নিষ্পাপ মন যেন হাড়ানো শান্তকে খুজে পেল।

এরপর থেকেই শুরু হয় পুতুল ও মেছোবাঘের গল্প। পুতুল সকলের কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে নতুন শান্তর জন্য খাবার নিয়ে আসত, আর শান্ত পুতুলের অবস্থান টের পেলেই ঝোপ থেকে বের হয়ে মিউ মিউ করে নিজের অবস্থান জানান দিত। শান্ত যখন খেত তখন পুতুল তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিত ঠিক যেভাবে সে তার ভাইকে হাত বুলাত। আদর পেয়ে শান্ত আরও শান্ত হয়ে গুটিসুটি মেরে পুতুলের পায়ের কাছে এসে বসত। পুতুল তখন শান্তকে বলত, “ঢং করার আর জায়গা পাসনা, তাই নারে শান্ত”। অবুঝ প্রাণী, কি করবে? মা থেকেও নেই। মায়ের পচা শরীরটা মাটি ও পোকামাকড়ে আস্তে আস্তে গ্রাস করছে। তাই ছোট্ট পুতুলের কাছে সামান্য মায়ের আদর পেয়ে শান্ত আরও শান্ত হয়ে যায়। তাই সে নির্বিগ্নে পুতুলের ছোট বড় লাথি আর কিল সহ্য করতে লাগলোসময় যত গড়াতে থাকে পুতুল ও মেছোবাঘের সম্পর্কটা আরও গভীর হতে থাকে কিন্তু সেটা আর গোপন থাকেনা। পৃথিবীতে কেউ মায়ের কাছে কিছু গোপন করতে পারেনি, ছোট্ট মেয়ে পুতুলও পারলনা তার মায়ের কাছে ‘পুতুল ও মেছোবাঘের গল্প’ গোপন করতে। 

প্রথম প্রথম পুতুলের মা ব্যপারটাকে ভালো চোখে দেখেননি। পরে পুতুলের নাছোড়বান্দা অবস্থা দেখে ব্যাপারটা মেনে নেন। কিন্তু বাঘটিকে শান্ত বলে ডাকায় তার মনে কষ্ট হত। অন্যদিকে নতুন শান্তকে পেয়ে পুতুল তার ভাই শান্তকে ফিরে পাওয়ার জন্য যে আবদার প্রতিদিন করত তা বন্ধ করে দিল। প্রতিদিনের অযথা কান্না বন্ধ হওয়ায় পুতুলের মা তা মেনে নিল। তবে সমস্ত ব্যাপারটি পুতুলের বাবার দৃষ্টি এড়ায়। সে এই সময়টায় বাড়িতে ছিলনা।

তিন
একদিন দুপুর বেলায় প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। পুতুল অনেক চেষ্টা করেও শান্তকে রাখার কোন স্থান খুজে পাচ্ছিলনা। পেছনে তার মা তাকে বৃষ্টিতে ভিজতে বারবার মানা করছিল। কিন্তু পুতুল তার শান্তকে ভিজতে দিতেই পারেনা। পুতুলের মা শান্তকে জঙ্গলে ফেলে আসার কথা বললে পুতুল কেঁদে কেঁদে বলে, “মা তুমি এত পচা কেন? আব্বুর মত তুমিও কি বাঘ মারতে চাও? তুমি আমার ভাইয়াকে ফেরত দিবে বলেছিলে, তুমি তাকে কোথায় ফেলে দিয়েছ? মা তুমি কি শান্তকেও  মেরে ফেলতে চাও? ”।  অবশেষে পুতুলের মা মেয়ের সুস্থতার কথা চিন্তা করে শান্তকে ঘরে রাখার অনুমতি দিলেন।

পুতুল সুযোগ পেয়ে শান্তর শরীরের পানি ভাল মত মুছে তার বিছানায় অন্য একটি বিছানা করে শুতে দিল। কিন্তু শান্ত তাতেও শান্ত হচ্ছিলনা। শুধু মিউ মিউ করছিল। হাজার হোক সেও তো বাঙ্গালি।  খালি শুতে দিলে হবেনা, খেতেও দিতে হবে। পুতুল তার ব্যপারটা বুঝতে পেরে তার আবদারটা পুরোপুরি মেটাল। তারপর দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে সে নিজেও শান্তর পাশে ঘুমিয়ে পড়ল। শান্ত পুতুলের অস্তিত্ব টের পেয়ে আরও কাছে ঘেঁষে শুতে চাইল। বৃষ্টিতে ভেজা শরীরে তারও কাঁথার নিচে শোয়া চাই। তাই বেড়ালের মত পুতুলের পাশে নিজের জায়গা খুজে নিল। শান্তর রোমশ শরীর পুতুলের গায়ে লাগতেই পুতুলের সুড়সুড়ি লাগল। সেও বুঝে গেল শান্ত তার কাঁথার ভাগ চাইছে। তাই সে বলল, “তুই তো ভারি দুষ্টরে শান্ত, খালি আমাকে কাতুকুতু দেস্”। পুতুল আস্তে আস্তে শান্ত গায়ে দুটো কিল কসাল। বরাবরের মতই শান্ত তা সহ্য করল।  অতঃপর পুতুল শান্তকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাল, ঠিক যেভাবে সে তার ভাইটিকে নিয়ে ঘুমাত।

সেদিন বিকেল বেলাতেই পুতুলের বাবা এসে হাজির। ঘটনাক্রমেই সে মেছোবাঘটার কথা জানতনা। সে যখন পুতুলকে আদর করতে আসলেন। তখন আন্ধকারে তার হাত রোমশ কিছুর উপরে পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেই তার ভয় পাওয়ার কথা। সে পুতুলের মাকে ডাকতে ডাকতেই একটা মোটা লাঠি দিয়ে শান্তর শরীরের উপরে মারল। আচমকা আঘাত পেয়ে শান্ত ম্যাও ম্যাও করে আওয়াজ তুলে দরজা দিয়ে ভোঁ দৌড় দিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল।  পুতুল আচমকা শান্তর আওয়াজ পেয়ে ঘুম থেকে জেগে গেল। চোখ খুলতেই সে তার বাবার হাতে লাঠি দেখল। তার আর বুঝতে বাকি রইলনা কি ঘটেছে। পুতুল কাঁদতে কাঁদতে ‘শান্ত’ ‘শান্ত’ করে চিৎকার করতে করতে বাইরে বেড়িয়ে এল। তারপর প্রচন্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করেই শান্তকে খুজতে বের হল। বাবলা গাছের তলায়, কচু গাছের ঝোপে কিংবা তার পুতুল খেলার ঘরে কোথাও সে শান্তকে খুজে পেলনা। অবশেষে তাদের বাড়ির বাগানের কোনায় জঙ্গলের ভিতরে শান্তকে খুজে পেল। সে তার পচে গলে যাওয়া মায়ের কাছেই শেষ আশ্রয় খুজতে এসেছে। আঘতের তাড়নায় অস্ফুট স্বরে কোকাচ্ছে। পুতুলের ডাকে শান্ত সারা না দিলে পুতুল অতি উৎসাহি হয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকল। কিন্তু পা পিছলে পাশের ডোবায় পরে যেতে লাগল। পুতুল পরেই যেত কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সে ডোবার খাদে ঝুলে রইল।  কারণ শান্ত তাকে পেছন থেকে কামড়ে ধরে তার চার পায়ের নখ দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে ছিল। এ ঘটনাটা পুতুলের সে এ্যাবনরমাল ফুপু দেখতে পেয়েছিল। সে এটা দেখে প্রচন্ড খুশিতে চিৎকার করতে লাগলো।

পেছনে পুতুলের বাবা মেয়ের পিছু পিছু দৌড়ে এসেছেন। সে তার মেয়ের সাথে বাঘের ব্যাপারটি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলনা। জঙ্গলের কাছে আসতেই মেয়ের এ অবস্থা দেখে সে মনে করল বাঘটা বুঝি পুতুলের শরীর কামড়ে ধরেছে। তাই মেয়েকে বাঁচাতে হাতে থাকা লাঠিটা দিয়ে শান্তর গায়ে প্রচন্ড আঘাত করল। আঘাত পেয়ে শান্ত পুতুলকে ছেড়ে দিয়ে আস্তে করে কাত হয়ে পরে গেল। পুতুলের শান্ত পুতুলের দিকে চেয়ে থেকে শুধু একবার মিউ করে আওয়াজ করল। তারপর তার নাক মুখ দিয়ে অঝোরে রক্ত ঝড়তে লাগলো। ততক্ষনে পুতুলের বাবা পুতুলকে উঠিয়ে এনেছেন। পুতুল তার বাবার কোল থেকে হাত পা ঝাড়া দিতে লাগলো। সে শান্ত শান্ত করে চিৎকার করতে করতে বাড়ি মাথায় তুলল। তার মা তাকে বারবার বোঝাতে লাগলো, সে আবার তাকে জঙ্গল থেকে শান্তকে ধরে নিয়ে আসবে। কিন্তু পুতুলের একই কথা, সে তার ভাইয়াকে ফেরত দেয়নি, এবার শান্তকেও ফেরত আনবেনা। অন্যদিকে ততক্ষনে শান্ত তার মায়ের মরা লাশের স্থানটিতেই চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছে। সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নামে কিন্তু পুতুলের কান্না থামেনা। সে তার বাবাকে কিছুতেই তার পাশে ঘিষতে দিলনা।

এ ঘটনার পর থেকে পুতুল সুযোগ পেলেই শান্তর মরা লাশের পাশে যেয়ে বসে থাকত। তার মা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেত। একদিন সুযোগ বুঝে পুতুল শান্তর খুব কাছা কাছি চলে আসল। সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছিল তাই মাটি পিচ্ছিল ছিল। অসাবধানতা বশত পুতুল পা পিছলে জঙ্গলের পাশের ডোবায় পরে গেল। আজ আর শান্ত নেই, তাকে কে কামড়ে ধরে রক্ষা করবে। তাই শান্তর পাশেই পুতুলের সলিল সমাধি হল।  বরাবরের মত পুতলের এ ঘটনাটা তার সে এ্যাবনরমাল ফুপু দেখতে পেয়েছিল। সে চিৎকার চেঁচামেচি করেও কাউকে সেখানে নিয়ে আসতে পারলনা।

চার

পুকুর পাড়ের বাবলা গাছের মাঝদিয়ে সুর্যটা আবছা এখনও দেখা যায়। কিন্তু গাছের পাতাগুলো শুকনো, কচু পাতার মাঝে জমে থাকা পানি আর নেই। কিন্তু সূর্য তার নিয়ম মাফিক কাজ করে যাচ্ছে। আর সন্ধ্যা নামলেই লোকেরা লাঠিসেটা নিয়ে বের হবে মেছোবাঘ মারতে।

পরিশিষ্টঃ
গল্পে পুতুল আমাদের ভবিষৎ প্রজম্ম আর পুতুলের বাবা হলাম আমরা যারা নির্বিচারে বাঘ মেরে পুতুলের মত আমাদের ভবিষৎ প্রজম্মকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। পুতুলের এ্যাবনরমাল ফুপু আমাদের মত নির্জিব দর্শক যার কথার কোন দাম নেই, শুধুই চেঁচামেচি। 

কোন এক বাঘ দিবস উপলক্ষ্যে লেখা


Share:

কা-যুদ্ধ

কা-যুদ্ধ
মৃধা বাড়ির মস্ত বড় আম গাছটির মগডালে বাসা বানিয়েছিল নিমাই কাক নামের বড়ই আলসে প্রকৃতির এক কাকঅনান্য কাকদের মত তার এত সকালে ঘুম থেকে জাগবার অভ্যাস ছিলনা। আলসামো করে সে একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠত। কাকেরা এ নিয়ে প্রায়ই ঠাট্টা তামাশা করত। তবে নিমাই কাক কখনোই এসবে পাত্তা দিতনা। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে অনান্য কাকেরা যেখানে চেঁচামেচি শুরু করত, সেটা তার পছন্দ হতনা। সে বরং ঘুমিয়ে অতিরিক্ত আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে দিত।

একদিন হলো কি, বাইরে অনান্য কাকদের অতিরিক্ত চেঁচামেচি শুনে নিমাই কাকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে হট্টগোলের মধ্যে না যেয়ে অন্য কারো কাছ থেকে খবর পাবে এই আশায় বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকবার পর সে যখন কাউকেই নাগালের মধ্যে পেলনা তখন বাসা থেকে গলা বাড়িয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। নিমাই কাকের প্রতিবেশী কণ্ঠী কাক সে প্রতিদিন সকাল বেলায় তার বাচ্চাদের
কা-সংগীত শেখাতে ব্যস্ত থাকত আজও সে তার নিজের ছানাদুটি সাথে তাল মিলিয়ে গম্ভীর গলায় কর্কশ সুরেকা-কা, কাও-কাওবলে গানের সুর তুলছিল। কিন্তু বেজন্মা কোকিলের বাচ্চাটা কিছুতেই গান শিখতে পারছিলনাকণ্ঠী কাকের মতে, ওর গলাটা ভালোনা, আর অপরিপক্বতাই সে যতই তাকে কা-কা বলে গাইতে বলে সে ততই মিহি কণ্ঠে, নাকি সুরে মিষ্টি করে বলে কুহু কুহু’

অলস নিমাই কাক তার বাসা থেকে মাথাটা সামান্য বের করে কণ্ঠীকে বলল, “ কণ্ঠী তুই গিয়ে দেখে আয়তো কি হয়েছে ওখানে?কণ্ঠীর মুরুব্বি হওয়াতে সে না’ বলতে পারলনা, সে তার গান শেখানো বাদ রেখেই ছুটল জটলার দিকে। সে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ নিমাই কাক অপেক্ষা করল, কিন্তু কণ্ঠী আসলো না নিমাই বুঝতে পারলো, সত্যই কিছু একটা হয়েছে। এখন সে না গেলে কাক সমাজে তার মর্যাদা কমে যাবে, তাই সে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল

নিমাই কাক ঘুমের ঘোরে কোন রকমে কাক-সভার ঠিক মাঝখানে গিয়ে বসল। হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসায় কাকেরা তার দিকে কটমট করে চেয়ে থাকল। নিমাই চোখ না খুলেই বলল, “ কি হয়েছেরে এইখানে? এত সকাল বেলায় চিৎকার কিসের?”

এত বড় দুঃসংবাদ সে জানেনা, তাই সকলের রাগ হল সে মুরুব্বি বলে কেউ কিছু বললনা। কাকদের মধ্যে শ্যামল কাক একটু হুজুগে প্রকৃতির ছিল। সে বলেই ফেলল,দেখছেননা কি হয়েছে? আপনার মত দিনের বেলায় ঘুমায়ে ঘুমায়ে মাকাল ফল খাওয়ার স্বপ্ন দেখলে কি কাকদের দিন যাইবে?”

শ্যামল কাকের কথায় নিমাই কাকের ঘুম ঘুম ভাব চলে গেল। সে চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল কে এত বড় কথাটা বলল? তাতেই এক সময় তার চোখে মৃত কাকটি পড়ল। নিমাই তাতে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকল। তারপর তার ঘুম ঘুম চোখে কান্না না আসলেও কান্না ভাব করে বলল, “ওরে আমার বন্ধু মতিরে কে মারল?”

শ্যামল কাক: উহু এতক্ষণে আসছে সে বন্ধুর খবর নিতে।

ছোটকু কাক: মতির জানাজা হইবার পথে, আর সে এখন আসছে দরদ দেখাইতে।

নিমাই কাক তাদের কথায় একটু রেগে বলল, কার এত বড় সাহস যে আমার কাক বন্ধুরে মাইরা ফেলে?”

শ্যামল কাক: কার আবার! ছেদু মিয়ারকাইলকাই সে আমার বাসায় ঢিল ছুইড়া আকলীর মায়েরে আধমরা কইরা ফালাইছে, আর আইজ............।

অতি আবেগে  শ্যামল কাকের কন্ঠরোধ হল। 
 
নিমাই কাক রাগত স্বরে বলল, ওরে ছেদু মিয়া জানেনা আমারা কাকেরা ছেদু মিয়ার বাড়ি ঘেরাও করলে সে তো দুরের কথা, তার চৌদ্দ গুষ্টিও ঘর থাইকা বাহির হইতে পারব না, আর সে আমার বন্ধুরে মাইরা ফেলে!

এবার কাকদের শক্তিমত্তা নিয়ে কথা বলায় মুহূর্তের মধ্যেই সবার মাঝে নিমাই কাকের অবস্থান পরিবর্তন হল নিমাই এইবার খুব সত্য কথাটি বলেছে। কাকেরা নিচু গলায় নিমাই কাকের কথায় সায় দিতে থাকল। কিন্তু ছেদু মিয়ার বিরুদ্ধে চুড়ান্ত যুদ্ধে যাবার আগে কাকদের সর্দার কবি কাকের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইল। কবি কাক চোখ বন্ধ করলেন। বাকি কাকেরাও নিশ্চুপ। কবি কাকও নিশ্চুপ। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাবার পর কবি কাক নিরবতা ভাঙ্গলেন। তার স্বভাবসুলভ কবিতা পাঠ না করে বেশ আবেগী ভাষায় বলতে লাগল, “আর একটা ঢিলও যদি ছেদু মিয়া আমাদের দিকে ছোঁড়ে, তাহলে তার যথাযথ জবাব দিতে আমরা কাকেরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাব। এই গাছ আমাদের, আর আমাদের দখলেই থাকবে”।

এ কথা বলেই বৃদ্ধ কবি কাক মগডালের দিকে ঊড়াল দিল। এদিকে কাকেরা যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ন প্রস্তুত হয়ে রইল। কিছুক্ষনের মধ্যে তাদের  অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে গেল। দুষ্ট বালক ছেদু মিয়া মতি কাকের লাশের আস পাশ থেকে কাকদের সরানোর জন্য ঢিল ছুড়তে লাগল। অতর্কিত হামলায় কাকেরা প্রথমে পিছ-পা হলেও কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আবারো ফিরে এল। কাকেরা একের পর এক ছোঁ মেরে ছেদু মিয়াকে পেছনে সরিয়ে দিল। ছেদু মিয়া কাকদের অলক্ষ্যে বাড়ির আড়ালে চলে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যেই তারই বয়সী বেশ কয়েকজন সাঙ্গো পাঙ্গো নিয়ে হাজির হল। এর পরেই শুরু হল তুমুল কা-যুদ্ধ। ছেদু বাহিনী ঢিল ছোঁড়ে আর কাকেরা ছোঁ মেরে তাদের ভয় দেখায়। ছেদু বাহিনী দেয়ালের আড়াল থেকে ঢিল ছুড়তে শুরু করায় কাকেরা আর পেড়ে উঠছিলনা। বেশ কয়েকটি কাক আহত হয়ে গেল।

এদিকে নিমাই কাক যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে কিছু দূরে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। ডাকে সারা দিতে ছেদু মিয়া নিমাই কাকেরই কাছাকাছি আসলো। কাজ শেষ করে ছেদু মিয়া যখন যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে ফিরছিল ঠিক তখনই নিমাই কাক হামলা করল। ছেদুর মাথার উপড়ে বসে সমস্ত শক্তি দিয়ে বেশ কয়েক বার তাকে কামড়ে দিল। ছেদুর চিৎকারে আসে পাশের বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করল। আর নিমাই কাক বিজয়ীর বেশে চিৎকার করতে করতে বলল, “ওরে ছেদু মিয়ার মাথা ছ্যাদা কইরা দিছিরে”।

চলন্তিকা ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত।


Share:

পৃষ্ঠাসমূহ

Popular

Translate

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

Like Us