This blog is about Bangle Ghost, Horror, Funny and fantasy story.

This blog is about Bangle Ghost, Horror, Funny and fantasy story.

চোর

গ্রামে চোরের উপদ্রব বেড়েছে। এলাকার সবাই তাই পাহাড়া বসিয়েছে। রাস্তার মোড়ে উঠতি জোয়ান ছেলেদের ভাব সাব দেখলে মনে হচ্ছে, যুদ্ধ লেগেছে বুঝি। বাড়ির মহিলারাও কাস্তে শাবল মাথার কাছে রেখে ঘুমুতে গেছে। গ্রামের কুকুরগুলোও চোর ধরার জন্য পেট পুরে খেতে পেয়েছে।

রাত দুইটা।

চারদিকে নিস্তব্ধ। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে গ্রামের যুবকেরা ঘুম ঘুম চোখে একে অন্যের দিকে চেয়ে আছে। কেউ ঘুমাচ্ছে তো তাকে টেনে উঠানো হচ্ছে। কিন্তু চোর না আসলে এভেবে আর কতক্ষন জেগে থাকা যায়। তাই একজন আরেক জনের উপরে মাথা রেখে ঘুমাতে লাগল।

হঠাৎ মৃধা বাড়ির এক বিয়ে বাড়ি থেকে ‘চোর’ ‘চোর’ বলে চিৎকার আসতে থাকল। প্রায় ঘুমিয়ে যাওয়া গ্রাম মূহুর্তের মধ্যেই জেগে উঠল। চারদিক থেকে নানা মানুষের ‘চোর’ ‘চোর’ বলে আওয়াজ আসতে থাকল। এমনকি মেয়ে আর ছোট পিচ্চিরাও চোর বলে চিৎকার করতে থাকল। বিভিন্ন দিক থেকে এত চিৎকারের মাঝে চিৎকারের মূল উৎসই হাড়িয়ে গেল। কোথায় চোর, আর কোথায় চোরকে ধরতে যাবে তাই কেউ বুঝলনা। মসজিদের মুয়াজ্জিন মাইকে ঘোষণা দিতে লাগল। কিন্তু কোন বাড়িতে চোর এসেছে তা সে বুঝতে পারেনি। এত চেচামেচির মধ্যে চোর কোথায় আছে তা বুঝতে না পেরে সবাই মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাছে গেল। সেও বলতে পারেনা চোর কোথায়। তবে মসজিদে আসায় বিফল হতে হলনা। সকল মানুষ এক সাথে হওয়ায় আসল কথা বেড় হল। তারপর দল বেধে মৃধা বাড়ির বিয়ে বাড়ি ঘেরাও করল।

বাড়িতে নতুন জামাই এসেছে, কনের গায়ে অলংকার আছে কয়েক ভরী। সকলের সন্ধেহ ঘনীভূত হল। চোর ব্যাটা বড় দান মারতেই ঘরে ঢুকেছে।   বিয়ে বাড়ির সব ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও চোর পাওয়া গেলনা। শুধু বাকি রয়েছে কনের ঘর। কিন্তু কেউ সেই ঘরে যেতে নারাজ। এমন কি উঁকি দিতেও নারাজ। অবশেষে পাশের বাড়ির চাচী আম্মাকে এই দায়িত্ব দেয়া হল। তিনি উঁকি দিয়ে দেখে সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। সবাই ভাবল, কী জানি দেখে ফেলেছে বুড়ি! কিন্তু বুড়ির মুখে কথা নাই। কয়েক সেকেন্ড পরে কথা বলল। তাদের মেয়ে নাকি খাটের নিচে মেঝেতে পড়ে আছে। সাথে সাথে কান্নার রোল পড়ে গেল। সবার সন্ধেহ জামাই বাবু চোর চোর বলে চিৎকার দেওয়াতে, চোর বুঝি দুই জনকেই মাইরা ফেলছে।

এই বাড়িতে মানুষ জন কম। তাই সাহস হয়নি চোরের মোকাবেলা করার। অগ্যতা দরজা ভাঙ্গা হল। বাতি জ্বালিয়ে সবাই দেখল জামাই বাবু নিশ্চিন্তে খাটের উপর ঘুমিয়ে আছে। আর কনে খাটের পাশে মেঝেতে ঘুমিয়ে আছে। ধাক্কা দিতেই দুইজনেই জেগে উঠল। বাইরে এত শব্দ হচ্ছে কিন্তু তাদের ঘুম ভাঙ্গেনাই কেন তাই বুঝতে পারলনা কেউ। কনের কানে তুলা দেওয়া। এটা আবিস্কার করা গেল, কনে কেন ঘুম থেকে জাগেনি। কিন্তু সে নিচে ঘুমিয়ে ছিল কেন, আর কেনই বা জামাই বাবু চোর ধরতে বাইরে বেরিয়ে আসেনি সেটা জিজ্ঞেস করতেই, জামাই বাবুর সাথে আসা দশ বছরের আক্কেল আলী চিঁচিঁ গলায় বলে উঠল, “আমাগো কিছলু মামার ঘুমের মধ্যি কথা বলার বদ অভ্যিস আছে, তাই সইতে না পাইড়া মামী জান নিচে গুমায় ছিল”।

অতঃপর সকলে বুঝল, সর্বপ্রথম চোর চোর বলে চিৎকার কে করেছিল। কিন্তু যুবক ছেলেরা যে লাঠিসোটা
নিয়ে, মেয়েরা যে কাস্তে শাবল নিয়ে চোর পেটাতে এসেছিল তার কি হবে?
Share:

বাচ্চা ভূতের জম্মদিনের পার্টি

ভুতেরা আমাদের মতই নিজস্ব সমাজ নিয়ে বসবাস করে। ইদানীং ভূতদের সমাজে অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল। বয়স্ক ভূতদের ধারণা পাজি টাইপের ছেলে-মেয়েদের ঘাড়ে অল্প বয়সী ভূতেরা চেপে বসাতে এই অবস্থা। সেই ছেলে-মেয়েগুলির বিভিন্নকর্মকান্ড তাদেরও প্রভাবিত করছে। আর এতেই হয়েছে বিপত্তি। গ্রামের উঠতি নেতা ছেনু মিয়ার ইঁচড়ে পাকা ছেলে গেদু মিয়ার ঘাড়েই চেপে বসেছিল বাচ্চা ভূত। প্রথম প্রথম সে গেদু মিয়ার ঘোর বিরোধী ছিল। কিন্তু ইদানিং সে উল্টো গেদুর অনুসরন করে। আর এ নিয়ে প্রায় দিনই বাচ্চা ভূতের সাথে তার দুসম্পর্কের বড় ভাই কাচ্চা ভূতের সাথে লেগে থাকত।
গেদুমিয়া ঘটা করেই নিজের জম্মদিন পালন করেছিল, আর বাচ্চা ভূতও তার সাথে মজেছিল। রাতভর জম্মদিনের আনন্দ ফূর্তি করে বাচ্চা ভূত বিকেলে এল কাচ্চা ভূতকে খোঁচা দিতে। কাচ্চাও কমে যায়না। সেও প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল। বাচ্চা ভূত কাচ্চা ভূতকে দেখে দূর থেকে বেশ জোর গলায় বলতে লাগল, “আহ, কাল রাত্রে জম্মদিনের কী পার্টিটাই না দিলাম”।             

একথা শুনে কাচ্চার গায়ে জ্বালা করল, কিন্তু সে দমলনা। সেও বলতে লাগল, “পার্টি না ছাই, কপাল গুনে অমাবশ্যা রাইতে জম্মদিন পাইছিলি। আর সেই সুযোগে ছেনু মিয়ার পুকুরের মাছ সাবাড় করছত। আর এখন খুব বড় গলায় বলতাছত ‘পার্টি দিছি’। সারা জীবন তো মাছ খাওয়ার লাইগ্যা আমার পিছে পিছে ঘুরতি”। 

 বাচ্চা ভূতঃ চিন্তা কইরো না, তুমার লাইগ্যা দুই চাইরটা অবশিষ্ট আছে। কাচ্চা ভূতঃ না খাইয়া থাকুম, তাও তোর ধরা মাছ আমি নিমুনা্‌, খামুনা।

 বাচ্চা ভূতঃ না খাইলে নাই, আমার মাছ খাওনের অনেক ভূত আছে। আমি ফা-চল্লিশের কাছে যাইতাছি। (ফা-চল্লিশ বাচ্চা ভূতের সমবয়সী মেয়ে ভূত। ইদানীং তার সাথে সে খুব ভাব দেখায়) 

 কাচ্চা ভূতের বিকেলের নাশতা করা হয়নি। সে ভাবল এমন ফ্রি মওকা কি বারবার আসে! তাই পেছন থেকে বাচ্চাকে ডাকল, “আরে যাবি যা, তোর এই চুনো পুঁটি কে খায়? তাও ছেনুর পুকুরের”।

 বাচ্চা ভূতঃ তোমার মত চুনো পুঁটি আমি খাইনা, আমিতো তেলাপিয়া খাই। 

 কাচ্চা ভূত বাচ্চাকে প্রশংসা করে বলল, “হু, তুই বুঝি মস্ত শিকারী হয়ে গেছিস রে। দেখি তো তেলাপিয়া মাছগুলো কত্ত বড়”। 

 নিজের প্রশংসা শুনে বাচ্চা খুশিতে গদ গদ হয়ে গেল। সে কাচ্চার কাছে এসে একে একে তার মাছ দেখাতে লাগল। কাচ্চা প্রথমে খুব খুশি হল। কিন্তু পরমূহুর্তে মন খারাপ হয়ে গেল। মাছগুলো সবই আধা খাওয়া। বাচ্চা ইচ্ছে করেই এমন করেছে, যাতে কেউ না খায়। কিন্তু কাচ্চা হাড়বার পাত্র নয়। সে কিছু না বলেই একটা মাছ খেতে শুরু করল। এ অবস্থা দেখে বাচ্চা ভূতের দুঃখে বুক ফেটে যাবার উপক্রম। তার কৌশল কাজে দেয়নি। সে কাচ্চা কে কিছু বলতে পারছেনা। কিন্তু সামান্য সময়ের মধ্যে খোঁচা দেবার কৌশল বের করে ফেলল। সে মুখ ভেংচিয়ে বলল, “আমাদের জম্মদিনের খাবার তো খাইলা, তয় কাচ্চা ভাই, তোমার কিছলু ভাইয়ের জম্মদিন কবে? পার্টি টার্টি দিবানা”? (কিছলুর উপর কাচ্চা ভড় করেছিল)

 বাচ্চা ভূত জানত কিছলুর জম্মদিন সে নিজেই জানেনা, আর কাচ্চা তো দুরের কথা। তাই একটা কঠিন খোঁচা দেয়া গেল। কাচ্চা ভূতের ততক্ষণে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সে জানে এর উত্তর নেই। কিন্তু সে কি দমবার পাত্র। সে খুব জ্ঞানী মানুষের মত বলে উঠল, “আরে তোগ জম্মদিন আর আমাগো। কত্ত তফাত! আমাগো সময়ের ছেলে মেয়েরা মায়ের কাছে নিজের জম্মদিন জিজ্ঞেস করলে তাদের মা বলে, ‘হ্যাঁ গো কিছলুর বাপ, আমাগো কিছলু আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহে হইছিল না?’ আর তোগ জম্মদিন। গেদু হওয়ার পাঁচ মাস আগেই ডাক্তারে জম্ম তারিখ সময় সহ কইয়া দিছে। ডাক্তারে যেন আগের তনেই জানে গেদুর মারে অমুখ তারিখে সিজার কইরা গেদুরে বাইর করব”।
Share:

ভৌতিক গল্পঃ অদৃশ্য রোগী (Bangla Horror Story)


শহরের অদূরেই বেশ পুরনো একটি ডিসপেনসারি। বাইরে থেকে এর নাম বা ডাক্তারের পরিচিতি কিছুই বোঝা যায়না। খুব কাছ থেকে শুধু ডিসপেনসারি শব্দটিকেই অস্পষ্ট বোঝা যায়। সবাই অবশ্য এটিকে ডাক্তারখানা বলে।

 প্রায় তিন দশক ধরে এই স্থানেই স্বপন ডাক্তার এই এলাকার হাজারো মানুষের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। কোথায় থেকে তিনি ডাক্তারি পাশ করেছেন কিংবা ডাক্তারি প্র্যাকটিস করেছেন তা কারোই জানা নেই। শহরে পাশ করা ডাক্তারের অভাব নেই। তবুও সকলের একই কথা, “স্বপন ডাক্তারের হাত ভাল, রোগী ভাল হয় তাড়াতাড়ি”।

এলাকায় তার নামে নানা অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য সব মুখরোচক ঘটনা প্রচলিত আছে। স্বপন ডাক্তারকে এই ব্যপারে কেউ জিজ্ঞেস করলে সে তা এড়িয়ে যায়। তবে মাঝে মাঝে সে কিছু নতুন কথা জুড়ে দেয়। স্বপন ডাক্তারের বহু পুরনো রোগী আছে। সে তার পুরনো রোগীদের আলাদাভাবে দেখভাল করে। নতুন রোগীদের সে ডাক্তারখানায় বসে চিকিৎসা দিলেও পুরনোদের প্রয়োজনে রাত বিরাতে তাদের বাসায় যেয়ে উপস্থিত হয়।

 পৌষ মাসের এক ঠাণ্ডা রাতে স্বপন ডাক্তারের সাথে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে গেল। সেদিন মাঝারী ধরনের বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। শীতকালে সাধারণত এমন দিন খুব কমই পাওয়া যায়। ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পেড়ে স্বপন ডাক্তার সন্ধ্যে না নামতেই ডিসপেনসারি বন্ধ করে দিল। তাদের বুড়ো আর বুড়ির ছোট্ট সংসার। ছেলেপুলের মুখ তারা দেখেনি। এই বৃদ্ধ বয়সেও এ জন্য বুড়িকে সে মাঝে মধ্যে বকা ঝকা করে। কিন্তু বুড়িকে ভুলে গিয়ে অন্য কারো সাথে সংসার পাতার ইচ্ছেও সে করেনি। সেদিন ডিসপেনসারি বন্ধ করে ঘরে এসেই বুড়িকে চায়ের অর্ডার দিয়ে লেপের তলায় যেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল সে। শীতে তার হাত পা কাঁপছিল। পা দুটো গরম করতে হাত দিয়ে ডলতে থাকল। চায়ের আশায় বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন চা নিয়ে কেউ আসলনা, তখন তার মেজাজ বিগরে গেল। দেরী করার জন্য বুড়িকে গাল মন্দ করতে থাকল। কিন্তু অন্য দিনের মত আজ আর বুড়ি তার কথায় উত্তর দিচ্ছিলনা। এতে মেজাজ আরও বিগড়ে গেল। রাগের মাথায় ঠাণ্ডা উপেক্ষা করেই রান্না ঘরের দিকে হাঁটা দিল। সেখানে যেয়ে দেখল তার স্ত্রী সেখানে নেই। চুলোয় পানি গরম হচ্ছে ঠিকই। পাশেই তার চশমাটা রাখা। স্বপন ডাক্তার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে লাগল। আশে পাশে কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেলনা। স্বপন ডাক্তার ভাবল তাঁকে না বলেই বাইরে কারো উপকার করতে চলে গেছে। তাই সে রাগে গজরাতে গজরাতে নিজের খাটের পাশে গিয়ে বসল। সাথে সাথেই বাইরে থেকে অদ্ভুত এক কণ্ঠে কেউ তাকে ডেকে উঠল। ডাক শুনে স্বপন ডাক্তারের সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। মাঝ রাতেও তাকে অনেকে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু আজ এই সন্ধ্যে বেলাতেই এক ডাকে তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে।

স্বপন ডাক্তার উত্তরে বলল, “বাইরে কে ডাকে রে?”

 বেশ কিছুক্ষণ কোন সাড়াশব্দ মিলল না। তারপর খুব রুগ্ন কণ্ঠে কারো ডাক শুনল। সে কান পেতে শুনল। কেউ তাকে বলছে, “ডাক্তারবাবু বাসায়? এখুনি একটু হাওলাদার বাড়ী চলেন না”।

 হাওলাদার বাড়ির নাম শুনে স্বপন ডাক্তারের চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল। হাওলাদার মশায় অনেক দিন ধরেই অসুস্থ। তার কাছে রাত বিরাতে গেলে একটু কষ্ট হয় বটে, কিন্তু তিনি হাজার টাকা হাতে গুজে না দিয়ে তাকে আসতে দেন না। সাথে ফ্রী গরম চা সিগারেটতো আছেই। হাওলাদার মশাই তার পুরনো রোগী। আবার বুড়ির উপর একটু রাগ হচ্ছে। এই সুযোগে বউকেও একটা উচিত শিক্ষা দেয়া যাবে। তাই সে ধুলো পড়ে যাওয়া রেইন কোটটা গায়ে চাপিয়ে বুড়িকে না বলেই হাওলাদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। পেছনে দরজা খোলাই থাকল।

 হাওলাদার বাড়ি তার বাড়ি থেকে খুব বেশী দুরের পথ না। আধা কিলোর কম হবে। রাস্তায় অন্ধকার। তাই বৃষ্টিতে টর্চ জ্বেলেও হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। টর্চের চার্যও শেষের দিকে। কে জানত তাকে এমন দিনে বাইরে বেরুতে হবে। বেশ কিছুদূর যাবার পর তার মনে হল যে তাকে ডেকেছে সে লোকটিকে একবারের জন্যও সে দেখতে পায়নি। এতে খুব অবাক লাগল তার । কি এমন তাড়া ছিল যে লোকটি তাকে না বলেই চলে গেছে? স্বপন ডাক্তার একবার ভাবল ফিরে চলে যাবে। কিন্তু বুড়ির উপর জেদের কাছে পরাজিত হল। তারপর প্রায় বিশ মিনিট অনেক কষ্ট করে হেঁটে অবশেষে হাওলাদার বাড়িতে পৌছুলো।

 হাওলাদার সাহেবের প্রকাণ্ড বাড়ি। বাড়িতে থাকবার জায়গার অভাব না থাকলে কি হবে, থাকার মানুষ নেই। তার স্ত্রী গত হয়েছেন দেড় বছর আগে। দুই ছেলেই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মেয়েটিও পরিবার নিয়ে কানাডা থাকে। স্ত্রী মারা যাবার পর মেয়ের কাছে বেশ কয়েক মাস ছিলেন। মেয়েটিও তাকে দেশে রেখে আবার বিদেশ চলে গেছে। যাবার আগে বলে গেছে, তার বাবাকে সেখানে দেখবার কেউ নেই। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকুরী করে। তার মা মারা যাবার পর সে নাকি বেশ পাগলামো করতে শুরু করে দিয়েছিল। সেদেশের আইন কানুন অনেক কড়া। কোন অঘটন ঘটলে তাদের আর সেখানে থাকবার উপায় থাকবেনা। অনেকেই তার মেয়ের এই যুক্তিগুলো মেনে নিলেও এলাকার বেশিরভাগ মানুষই হাওলাদার সাহেবের ছেলে মেয়েদের প্রচুর সমালোচনা করে।

হাওলাদার সাহেব আগা গোরাই খিট খিটে মেজাজের হওয়ায় কেউ তাকে পছন্দ করত না। লোকজন বাড়ির আশে পাশেও খুব একটা আসত না। দুই জন কাজের লোক দিন রাত তার দেখ ভাল করত। বাড়িতে প্রবেশ করে স্বপন ডাক্তার কাজের লোক দুটির কাউকেই দেখতে পেলনা। বেশ পুরনো বাড়ি। হিন্দু সম্পত্তি কিনেছিলেন হাওলাদার সাহেব। বাড়ির এখানে ওখানেই মানুষের মূর্তি এখনো অক্ষত আছে। বাইরে ঘন অন্ধকার। চারদিকে বৃষ্টির আওয়াজ ছাড়া কিছুই স্বপন ডাক্তার কানে যাচ্ছিলোনা। বেশ অস্বস্তি লাগছিল তার। এমন ছমছমে পরিবেশে সে কখনো এ বাড়িতে আসেনি। সে খুব সাবধানে পা টিপে টিপে বাড়ির আঙ্গিনা পেড়িয়ে বারান্দায় উঠতে যাবে ঠিক তখনই হঠাৎ করে বাইরে মৃদু বিজলী চমকাল। আঁতকে উঠে স্বপন ডাক্তার সামনে চেয়েই ভয় পেয়ে গেল। তার মনে হল ঠিক তার সামনে একটি প্রকাণ্ড মূর্তি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তার বুকটা ধক করে উঠল। আসলেই সেটা কি বুঝে উঠবার আগেই আকাশের আলো গায়েব হয়ে গেছে। সে নিজের টর্চ জ্বালালো। সামনে যেতে যেতে মুর্তিটিকে পার হয়ে গেছে ততক্ষনে। কি মনে করে আবারো সেই মুর্তিটির দিকে টর্চের আবছা আলো ফেলল। কিন্তু সাথে সাথেই টর্চ নিভিয়ে ফেলল। আবারো সে যা দেখল তা আর দেখতে চায়না। এতক্ষণ যা তার কাছে শুধু অদ্ভুত মনে হয়েছিল, এখন সেটা বাস্তব মনে হল। কারণ মুর্তিটি তখনো তার দিকে তখনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়েছিল। তাড়াহুড়ো করে সামানে এগুতে যেয়ে বৃষ্টিভেজা বারান্দায় সে পিছলে পড়ে গেল। স্বপন ডাক্তারের তখন মনে হল, আজ বুঝি তার আর রক্ষা নাই। ভীত কন্ঠে সে কাজের লোকের নাম ধরে ডাকতে যাবে ঠিক তখনই একটা ঘরের ভেতর থেকে কাউকে ডাকতে শুনলেন, “ডাক্তার মশাই, বাইরে দাঁড়িয়ে কি করেন? ভেতরে আসেন”।

 অনেকটা হাওলাদার সাহেবের গলার আওয়াজ শুনে সে অনেকটা স্বস্তি পেল। এ বাড়িতে এমন অভিজ্ঞতা তার কখনো হয়নি। এসেই অন্যরকম অভ্যর্থনা পেত সে। কিন্তু সেদিন কাউকেই দেখছিল না। ভয় পাবার লোক সে নয়। কিন্তু আজ বেশ ভয় পাচ্ছে। যে ঘর থেকে হাওলাদার সাহেব ডেকেছিলেন, সে ঘরে প্রবেশ করে প্রবেশ করে দেখল, ঘরে কেউই নেই। জানালা খোলা, সেখান দিয়ে অনবরত বৃষ্টির ছাট ঘরে প্রবেশ করছে। বোঝাই গেল অনেকক্ষণ ধরেই এই ঘরে কেউ আসেনি। তাহলে তাকে ডাকল কে? কথাটা ভেবে তার শরীরে শিহরন এল। এই ঘরে হাওলাদার সাহেব থাকতেন না কখনোই। তিনি উপরের তলায় থাকেন। কাজের লোকদের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে স্বপন ডাক্তার দোতালায় উঠে এল। উপরেও ঘন অন্ধকার। নিচে তাও কাজের লোকদের ঘরের বাতি থকে কিছু আলো পাওয়া যাচ্ছিল। উপরে এর ছিটা ফোটাও নেই। স্বপন ডাক্তার এইবার ভড়কে গেল। সে নিচে যে মুর্তিটিকে দেখেছে সে তার সম্মুখে আর যেতে চায়না। এর মানে তার এই বাড়ি থেকে বাইরে বেরুবার রাস্তা বন্ধ। এতক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করেও কাউকেই সে দেখছেনা। একেতো লোকজনের কোন হদিস নেই, অপরদিকে যার ডাকে এখানে এসেছে তার দেখাও মিলছেনা। শুধু অদ্ভুত এক কন্ঠে কেউ তাকে নির্দেশনা দিচ্ছে। নানা কথা চিন্তা করে সে সামনে না এগিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে টর্চ লাইটের নিভু নিভু আলো মেরে চারদিক দেখতে লাগল। কে জানত এমন অন্ধকার বাড়িতে রাত বিরাতে এসে তাকে এমন বিপদে পড়তে হবে। এখন তার নিজের উপরেও খুব রাগ হচ্ছে। রাগের মাথায় কিছু না ভেবেই চলে এসেছে। মোবাইলটাও সাথে আনতে ভুলে গেছে। একসাথে এতগুলো ভুল তার হয়না। আজ দিনটাই বুঝি অশুভ। অন্য কেউ হলে এতক্ষনে নানা দেবতা প্রভুর নাম ধরে ডাকতে শুরু করে দিত। কিন্তু স্বপন ডাক্তার যে পনের বছর ধরে রাম নাম মুখেই আনেনা। সেই যে তার ক্যান্সার রোগী মৃতপ্রায় দিদির আরোগ্যের জন্য মান্নত করে সে ব্যর্থ হয়েছিল, তা থেকে সে আর কাউকেই প্রভু মানেনা। হঠাৎ করেই স্বপন ডাক্তার তার নাম ধরে কাউকে ডাকতে শুনল। ততক্ষণে টর্চের চার্য একেবারেই শেষ। বুঝার উপায় নেই কে তাকে ডাকছে। মনে হচ্ছে দূর থেকে কেউ তাকে হাওলাদার সাহেবের মত করে ডাকছে, “ডাক্তার মশাই এইদিকে আসেন”। চারদিক থেকে এই ডাক প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অথচ বাইরের বৃষ্টির আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছেনা। কারো পায়ের আওয়াজও না। সেই ডাক বার কয়েক শোনার পর আর তা শোনা যাচ্ছেনা। তবে সে তার ঘাড়ের উপরে অজানা কোন শক্তির প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেছে। সেটি তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। স্বপন ডাক্তারের গলা দিয়েও কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। বাইরে বৃষ্টির আওয়াজও আর শোনা যাচ্ছেনা। ততক্ষণে সে একটি পচা দুর্গন্ধময় ঘরে এসে প্রবেশ করেছে। এরপরে কি ঘটবে সে অপেক্ষাতেই সে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি সেকেন্ড যেন তার কাছে এক একটি মিনিট মনে হচ্ছে। হঠাৎ করেই হালকা আওয়াজে বজ্রপাত হল। জানলা দিয়ে যে আলো ঘরে এল তাতে সে স্পষ্ট দেখতে পেল পচা গলা হাওলাদার সাহেবের লাশ বিছানার উপরে পড়ে আছে। আর সেই মুর্তির মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লাশটির চোখদুটি ঠিক স্বপন ডাক্তারের দিকেই চেয়ে আছে। লাশ দর্শনের পর কিভাবে যেন সেই শক্তিটি তার ঘাড় থেকে সরে গেছে। সুযোগ পেয়ে স্বপন ডাক্তারও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে অজানা অন্ধকারে ছুটল।

 পরদিন সকালে স্বপন ডাক্তারের আধা মৃত দেহ সেই মুর্তিটির কাছেই পাওয়া গেল। পুলিশ এলে আরও জানা গেল হাওলাদার সাহেবের দুই চাকরের কুকর্মের কথা। তারা দুজনেই চেলাই মদ আনতে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে আজ সাত দিন ধরে হাজত বাস করছে। এর মাঝেই কোন একদিন হাওলাদার সাহেব মারা গেছেন। কেউ জানতেও পারেনি ভেতরে কি হয়ে গেছে ? সবাই ভেবেছিল এখানেই বুঝি ঘটনার শেষ। কিন্তু স্বপন ডাক্তারের ঘটনা আরও রহস্যময় করতে আরেকটু এগুলো। কেউ তার স্ত্রীর কাছে দুর্ঘটনার খবর বলতে গেলে তাকে নাকি আশ্চর্য হতেই দেখা গেছে। কারণ সে বলছিল, তার পতি যদি হাওলাদার বাড়িতে যেয়ে থাকে, তাহলে সারা রাত ধরে তার পাশে লেপের তলায় কে শুয়ে ছিল? ..................সমাপ্ত.....................।

 লেখক পরিচিতি
 লেখকঃ তৌফিক মাসুদ
 email: md.masud172@yahoo.com website: www.taufiquemasud.blogspot.com
Share:

ভৌতিক গল্পঃ অন্ধকারে কে?



 সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ার পর থেকে বাবলা গাছের পাতাগুলো একটুকুও নড়ছেনা। পুরো পরিবেশটাই কেমন যেন গুমট অন্ধকারে ঢেকে আছে। বিকেল যে এত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে যাবে তা তপু একেবারেই টের পায়নি। শুধু তপু কেন, ওর সাথে থাকা আশিক, শহিদ, জাকির সবাই এতে একটু আশ্চর্য হয়েছে। এমন অসময়ে ঝড় নামবে তা কেউ মেনে নিতে পারেনি। সবে মাত্র ক্রিকেট ম্যাচটা জমে উঠেছে। কিন্তু কী করবে! পরিবেশের সাথে তো আর যুদ্ধ করা যায়না। পারলে আজকে ওরা তাই করত। হঠাৎ খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওরা সকলেই নিশ্চুপে মাঠের ধারে বসে আছে একটা নির্মাণাধীন বাড়ির পাশে।

দমকা বাতাস হয়ে ঝড় নামতে শুরু করল। কিন্তু ওরা বাড়ি যাবার একটুকুও চেষ্টা করলনা। তপুর বাড়ি নিকটেই। তার মা তাকে ডাকছে। কিন্তু তপু ভাবল, সে চলে গেলে তার বন্ধুরা যদি তাকে কাপুরুষ বলে। তাই সে বাড়ি না যেয়ে নির্মাণাধীন বাড়িটায় যেয়ে ঢুকল। বাকিরা ঝড় থেকে বাঁচতে আগেই ভেতরে বসে ছিল। বাড়িটার ভেতরে তপু ওর বন্ধুদের সাথে মিলিত হবার সাথে সাথেই বাইরে প্রচণ্ড বেগে ঝড় শুরু হল। ঝড়ের আওয়াজে এখন আর তপুর মায়ের কণ্ঠও শুনতে পাওয়া যাচ্ছেনা। নির্মাণাধীন বাড়িটির কপাট বিহীন জানালা দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বাতাস ঢুকছে। ওরা যতটা সম্ভব নিজেদের বাতাস থেকে আড়াল করে যাচ্ছে।

একটা সময় ওদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। বাড়ির ছাদ এখনো অপরিণত। টুপ টাপ পানি পড়ছে নিচে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওরা কেউ শুকনো থাকলো না। সবাই ভিজে একাকার। এই ঝড়ের মাঝে বাইরে বেড়িয়ে তপুদের বাড়িতে যাবার সাহস হচ্ছেনা কারোই। তাই সবাই মিলে এমন একটা জায়গা খুঁজছিল যেখানে পানি থেকে বাঁচা যায়। এক সময় নিরাপদ একটি ঘর পেয়েও গেল। এই ঘরটিতে বাড়ি বানানোর বিভিন্ন উপকরণ রাখা হয়েছিল। রাজমিস্ত্রিদের রেখে যাওয়া নোংরা চেয়ার ও টেবিলের উপরে সবাই বসলো। টেবিলের পেছনেই নানা ভাঙ্গা জিনিসের স্তূপ। অন্ধকার হলেও সেটা আন্দাজ করতে পারছিল ওরা।

বাইরে ঝড়ের প্রকোপ থাকলেও ভেতরে ওরা সবাই খোশ গল্পে মেতে উঠল। অন্ধকারে ওদের ভূতের গল্পগুলো নিজেদেরই চমকে দিচ্ছিল। শহিদের গল্পগুলোই ওদের বেশ ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল। বিশেষ করে তপুকে। ওরা যখন গল্পের মধ্যে জমে গেছে, এমন সময় হঠাৎ করেই ওদের পেছন থেকে নতুন কিছুর অস্তিত্ব টের পেল। একটা ভাঙ্গা স্তূপের মধ্যে থেকে কেউ নড়ে উঠল। ব্যাপারটা এক্কেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। তাই প্রথমে ওরা সবাই ভয় পেয়ে গেল। পর মূহুর্তে ভাবল বিড়াল হবে হয়ত। ওদের দেখে ভয় পাচ্ছে। কয়েক মুহুর্ত পরে ওটা আবার নড়তে শুরু করলেই ওরা বুঝতে পাড়ল এটা বিড়াল না। তার চাইতে অনেক বড় কিছু। এবার ওরা ভয়ে যে যার স্থান থেকে উঠে দাঁড়াল। ওদের আর কারোই সেখানে থাকার সাহস হচ্ছিলো না। তাই পড়িমরি করে ছুট দিল। তাড়াহুড়ো করতে যেয়েই তপু ওদের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। সবাই বের হয়ে গেলেও তপু একাই ঘরের ভেতরে রয়ে গেল। সে কোন রকমে উঠে দৌড় দিতে যাবে, ঠিক তখনি কেউ ওর পা চেপে ধরল। তপু প্রচণ্ড ভয় পেয়ে একটা চিৎকার দিল। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটতে চাইল। কিন্তু সেই অগান্তুকের হাত থেকে মুক্ত হতে পাড়লনা। তাই প্রাণ বাঁচাতে হাতে থাকা ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে অগান্তুককে লক্ষ করে জোড়ে আঘাত করল। তবুও ওটা কিছুতেই ওকে ছাড়ছিলোনা। সে আবারো চিৎকার করতে গিয়ে মূর্ছা গেল। চৌদ্দ বছর বয়সী তপু আর কত সাহস দেখাতে পারে?

 আশিক, শহিদ আর জাকির বাইরে বেড়িয়ে এলেও তপুর দেখা নেই। তারা শুধু ওর একটা চিৎকার শুনেছিল। বাড়ির ভেতরে যেতে ভয় হচ্ছে ওদের। ঝড় একটুকুও থামেনি। ঝড় ভেঙ্গে কাছাকাছি শুধু তপুদের বাড়ি যাওয়া যায়। কিন্তু ওর মাকে কি জবাব দিবে। ততক্ষণে আশিক তপুর নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছে। কিন্তু ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসছেনা। এবার ওরা আরও ভয় পেয়ে গেল। জাকির বলল, “ব্যাটা আমাদের ভয় দেখাচ্ছে নাতো, সবাই বের হয়ে এলাম আর ও একা......”। কথা শেষ হতে না হতেই বাড়ির ভেতর থেকে কারো চিৎকার শুনতে পেল। মনে হচ্ছে কেউ যেন ওদের শাসাচ্ছে। এবার আর কারোই সাহসে কুলালো না। সোজা দৌড় দিয়ে তপুদের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল। দরজার দিকে তাকাতেই সবার মুখ কাঁচুমাচু হয়ে গেল। তপুর মা দরজায় দাঁড়িয়ে। ওদের দেখেই খেঁকিয়ে উঠল, “তপু কোথায়?”

ওরা কেউ কোন কথা বলতে সাহস পেলনা। সবাই নিশ্চুপ দেখে তপুর আম্মা আরও জোরে ধমক দিলেন, এতে সবাই আরও ঘাবড়ে গেল। কেউ কথা বলছেনা দেখে তপুর আম্মা নিজেই ঘাবড়ে গেলেন। অজনা ভয়ে তার শরীর কেঁপে উঠল। নরম গলায় বলল, “বাবারা আমার ছেলের কী হয়েছে বলনা?” এবারে শহিদ সাহস করে মুখ খুলল, একে একে সব বলল। শহিদের কথায় তপুর আম্মা আশ্বস্ত হলেন। তার মুখ থেকে ভয়ের ভাবটাও কেটে গেল। ওদের সবাইকে নিয়ে সেই বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। ওরা একটু আশ্চর্য হল। এমন একটা ব্যপারে তিনি কাউকে না ডেকে একাই যাচ্ছেন সে বাড়িতে। আশিকদের কিছুই করার ছিলনা অনুসরণ করা ছাড়া। তপুর মায়ের হাতে লাইট ছিল। ওদের অন্ধকারের ভয় কেটে গেছে তাতে। সবাইকে আশ্চর্য করে তপুর মা একাই সেই নির্মাণাধীন বাড়িতে ঢুকল, কাউকে সাথে যেতে দিলনা। কয়েক সেকেন্ড পরেই ভেতর থেকে তপুর মায়ের চিৎকার আসল। সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখতে পেল তপু উপুড় হয়ে অজ্ঞান অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। সবাই ধরাধরি করে ওকে বাইরে নিয়ে এলো।

বাইরে ঝড় থামলেও বৃষ্টি থামেনি। বৃষ্টির পানি তপুর চোখে মুখে পড়তেই ও জেগে উঠল। ওরা তিনজনেই আনন্দে হালকা চিৎকার দিয়ে উঠল। তপুর মা থাকাতে সেটা আর জোড়ে হবার সাহস পেলনা। তপুকে বাড়িতে নিয়ে যাবার কথা বলে তিনি নিজে আবার সেই বাড়িতে ঢুকলেন। আশিক উৎসাহী হয়ে তার পিছু নিলো। এক কোনায় দাঁড়িয়ে সে দেখল, তপুর মা হন্য হয়ে অন্য কিছু একটা খুঁজছে, কিন্তু কি খুঁজছে তা বোঝা গেলনা। আশিকের উপস্থিতি টের পেয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এলেন। আশিকের দিকে খুব রাগী ভাব নিয়ে চাইলেন। আশিক বাড়ি থেকে বেড় হতে গিয়ে একটি প্লাস্টিকের প্লেটের উপর পা তুলে দিল। নিচে চেয়ে দেখল, কেউ এই প্লেটে বিরিয়ানী খেয়েছে, তবে সবটুকু খেতে পারেনি। আজকে দুপুর বেলায় তপুদের বাড়ি থেকে এই জিনিসটার গন্ধ বেরুচ্ছিল। সাধারণ এই ব্যপার নিয়েই অনেক কিছু ভাবা যায়। কিন্তু এখন সে সময় নেই।

 তপুর চোখ দুটি অসম্ভব রকমের লাল হয়ে আছে। ওর বিশ্রাম দরকার। ঝড় থামলে সবাই যে যার বাসায় চলে গেল। তপুর শান্তি প্রিয় বাবাটি ততক্ষণে চলে এসেছে। তপুকে নিয়ে ওর মা সবার অলক্ষ্যে নানা কথা জিজ্ঞেস করছে। যা যা হয়েছিল, তপু সব কথাই বলল। ওর মা সেগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তপু যখনই বলল, ওর পা যে ধরেছিল তাকে সে জোরে স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করেছে। অজ্ঞান হবার আগে সে অগান্তুকের চিৎকারও শুনেছিল। তপু ভেবেছিল এ কথায় তার মা খুব খুশি হবে, কিন্তু উল্টো তার গালে একটা থাপ্পড় পরল। তারপর তিনি কান্না লুকাতে অন্য ঘরে আড়াল হলেন। এখানে ওর কি ভুল হয়েছে তা সে বুঝতে পাড়লনা। তাই সে হতভম্বের মত বসে রইল।

 সকাল হতে না হতেই বাইরে লোকজনের চিৎকার, চেঁচামেচি শোনা গেল। তপু উৎসাহী হয়ে বাইরে বেড়িয়ে দেখতে পেল, বেশ কিছু প্রতিবেশী একটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন লাশের পাশে দাঁড়িয়ে নানা রকম মন্তব্য করছে। কার লাশ? কিভাবে এখানে এলো? তা কেউ বলতে পারছেনা। তপু ওর মাকে খবর দিতে গিয়ে দেখল, ওর মা আগেই জানালার পাশ থেকে বাইরে চেয়ে দেখছে আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তপু মা’ বলে ডাকতেই তিনি ফিরে চাইলেন, আর চাপা ক্ষোভ নিয়ে শুধু বললেন, “তুই একটা খুনি”।

মায়ের মুখে এমন একটা অপবাদ শুনে অজানা অতঙ্কে তপুর বুকটা ধক্ করে উঠল। তপু ব্যপারটি নিশ্চিত হতে চায়। তাই সে বেশ চিন্তিত মনে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে এল। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলনা, কিভাবে এই লোকটিকে সে খুন করল? কেন তার মা তার উপর এত্ত বড় অপবাদ দিলেন?

 লোকটির শরীরে পোশাকের ধরণ আর চেহারায় চুল দাড়ির জটলা দেখে নিশ্চিত পাগল মনে হল। তপু বুঝতে পাড়ল, গতকাল ঝড়ের সময় যে অগান্তুক লোকটি অন্ধকারে ওর পা ধরেছিল সেই এই পাগল। কিন্তু সামান্য স্ট্যাম্পের এক শক্ত আঘাতে সে মারা গেল তা কী ভাবা যায়! লোকজনের মুখে শোনা গেল শেয়ালেরা পাগলের লাশটি টেনে বাইরে নিয়ে আসে। তপু নিজেকে খুনি ভেবে ভয় পেয়ে গেল। আবার এই ভেবে সান্ত্বনাও পেল, এ কথা ওর মা ছাড়া আর কাউকেই বলেনি। পাগলটি মারা যাবার পর তপুর মা কেমন যেন হয়ে গেছেন। উঠতে বসতে তপুকে ধমকাচ্ছেন আর কাঁদছেন। পাগলের জানাজায় শরীক হবার জন্য খুব তাগিদ দিলেন সবাইকে। তপু মনমরা হয়ে সব আদেশই পালন করতে লাগল।

 রাত একটা বাজে।
তপু আনমনে কারণে অকারণে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। মায়ের আদেশ, রাত দুইটার আগে ঘুমুতে যেতে পারবেনা। তপু বুঝতে পেরছে তার মা ইচ্ছে করেই এমন আদেশ দিয়েছেন। নয়তো রাত বারোটার বেশী জেগে থাকার অনুমতি নেই। তিনি ইচ্ছে করেই তপুকে শাস্তি দিচ্ছেন। তপুও মুখ বুজে শাস্তি মেনে নিচ্ছে। 

বাইরে গাঢ়ো অন্ধকার। দুরে শেয়ালগুলো একটানা ডেকে চলেছে। তপুর কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। বার বার সেই পাগল লোকটির কথা মনে হচ্ছে। লোকটিকে তার খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। নিজেকে খুনি ভেবে ভয় পাচ্ছে সে। ভয়ে সারা শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে আছে। পড়ার টেবিলের সামনে জানালা খোলা, হঠাৎ করেই বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শুকনো মেঝের উপরে কারো খালি পায়ের আওয়াজ। আস্তে আস্তে আওয়াজের উৎসটা জানালার দিকে এগিয়ে আসছে। এত রাতে বাইরের বারান্দায় কেউ থাকবার কথা না। ভয়ে তপুর বুক ধক্ ধক্ করছে। জানালা লাগাবার সাহস হচ্ছেনা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেটি আরও কাছে চলে এলো, তপু ভাবছে এই বুঝি জানালার সামনে এসে যাবে সেটি। জানালার খুব কাছ থেকে পায়ের আওয়াজ আসতে লাগল, তারপর হঠাৎ করেই সেটি সামনে আসা বন্ধ করে দিল। ওর মনে হল পাশের ঘরে দরজা খোলার আওয়াজ হচ্ছে। বাবা মায়ের মধ্য থেকে কেউ বাইরে বের হচ্ছে মনে করে তপু সাহস পেল। বাইরে কে চুপিসারে দাড়িয়ে, তা দেখতেই তপু জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখল। কিন্তু আশ্চর্য বাইরে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। একটু এদিক সেদিক তাকিয়ে কাউকেই খুঁজে পেলনা। এতে তপু বেশ ভয় পেয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে জানালা বন্ধ করতে যেয়ে বুকটা ধক্ করে উঠল। হঠাৎ করেই জানালার ঠিক সামনে কারো অস্তিত্ব টের পেল সে। তার মনে হল সেই মারা যাওয়া দাড়ি গোঁফওয়ালা পাগল লোকটির মত একটা ছায়া মূর্তি জানালার বাইরে ঠিক ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

 তপুর চিৎকারে ওর বাবা মা বাইরে বেরিয়ে আসল। ঘর ভেতর থেকে বন্ধ, তপু অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। তাই দরজা ভাঙ্গা ছাড়া আর কোন উপায় থাকলনা। প্রায় আধাঘন্টা চেষ্টার পর তপুর জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফেরার পর সে যা যা দেখেছিল তার সবই ওর বাবা-মাকে বলল। তপুর বাবা সহজ সরল মানুষ, এ ব্যপারটাকে সাধারণ ব্যাখ্যা দিয়ে অবজ্ঞা করলেন। সব সময় তিনি এই কাজই করেন। কিন্তু তপু তার ব্যপারে সবসময় সরলতার অজুহাত মানতে নারাজ। সে যা দেখেছে তা সত্যি ভয়ের। এমনটা তার সাথে কক্ষনো হয়নি। তপুর কাছে ব্যপারটা ভয়ের হলেও ওর বাবা-মাকে তা বিশ্বাস করাতে পারছেনা। তপুর মা এককোণে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপে কাঁদছে। এর মধ্যে কাঁদার কি হল তা তপু বুঝতে পারলনা। সিদ্ধান্ত নিলো, এর মধ্যে সে আর মা বাবাকে জড়াবেনা। এটা নিয়ে শুধু বন্ধুদের সাথেই আলোচনা করবে।

 পরদিন স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে অনেক ব্যপারেই আলোচনা হল আশিক ও শহিদের সাথে। মারা যাওয়া সেই পাগলের মাঝ রাতে তার ঘরের সামনে হাঁটাহাঁটি, সে ঘটনাকে বাবার সরল অবজ্ঞা, মায়ের অযথা কান্না, সবকিছুই বলল। শুধু বললনা স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাতের বিষয়টি। আশিকও তপুর মায়ের যে যে আচরণ দেখেছিল তা বলল। বাদ গেলনা বিরীয়ানির সাথে থাকা প্লাস্টিকের প্লেটের কথাও।

 বিকেলে খেলতে না যেয়ে চুপিসারে তপু আবার সেই বাড়িতে ঢুকল। পাগলের লাশ পাওয়া যাবার পর থেকে কেউ আর এইদিকে আসেনা। আশে পাশে তাই কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। তপুর বন্ধুরা এই বাড়িতে আবার ঢুকতে নারাজ। কিন্তু তপুকে এই ঘটনার মীমাংসা করতেই হবে, আসলেই সে খুনি কিনা ? পাগলের মাথায় আঘাতের চিনহ দেখা গেছে। হয়তবা সেটি তপুর আঘাত থেকেই হয়েছিল। সেই ঘরটিতে যাবার পর আঘাতের ব্যপারে সে আরও নিশ্চিত হল। চারপাশে রক্ত ছিটিয়ে আছে। প্রাণ বাঁচাতে কেউ শেষ চেষ্টা বুঝে করেনা। তপুর বেলায়ও তাই হয়েছিল। সে এত্ত জোড়ে কাউকে মেরে খুন করতে চায়নি। তারপরেও তপু ধরেই নিলো সে খুনি। বাড়ি থেকে বেরোবার পথেই আশিকের বলা প্লেটটিও তার চোখে পড়ল। একটু আশ্চর্য হল সে, এটা নিশ্চিত তাদের বাড়ির প্লেট। প্লেটে থাকা বিরিয়ানি পচে গন্ধ বেরুচ্ছে।

 বাসায় যেয়ে তপু তার মাকে এই ব্যপারটি বলল। তিনি ছেলের হাতে সে প্লেট দেখে কান্না বেধে রাখতে পারলেননা। এবার তপুর উৎসাহের বাধ ভেঙ্গে গেল। সে জানতে চাইল এই পাগল লোকটিকে এত সমাদর করবার কি ছিল। তপুর মা ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন, তার মুখে এর জবাব ছিলনা। তিনি কিভাবে বলবেন তার ছেলেই নিজের অজান্তে নিজ বাবা অর্থাৎ পাগলটিকে হত্যা করেছে।

 এই পাগল লোকটির সাথে তপুর মায়ের বিয়ে হয়েছিল ষোল বছর আগে। পেশায় আইনজীবী ছিলেন। তপু তার ঘরেরই সন্তান, কিন্তু তপু তা জানতোনা। তপুর বয়স যখন দুই বছর, তখন একটি মামলা জনিত ব্যপার নিয়ে মক্কেলের সাথে খুব কথা কাটা কাটি হয়। এর পরেই সে কেমন যেন হয়ে যায়। চিকিৎসা সফল হয়না। তারপর ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যায়। একদিন কোন এক সুযোগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সেই থেকেই নিখোঁজ ছিলেন। রক্তের টানেই হউক আর আত্মার টানেই হউক, মৃত্যুর আগে নিজের অজান্তে প্রিয় মানুষের কাছেই ফিরে এসেছিলেন। তপুর মা বুঝতে পেরেছিলেন এটাই তপুর বাবা, তাই মানবিক কারণে সবার অলক্ষ্যে খাবার দাবার সহ সব কিছুই তাকে দিতেন। পরিচয় প্রকাশ করে তপুর সহজ সরল সৎ বাবাটিকে কষ্ট দিতে চাননি। কিন্তু তিনি কি জানতেন এমনটা হবে? এত্ত বছর পর তপুর আসল বাবার পরিচয় দিয়ে তপুকে কষ্ট দিতে চাইলেননা, নিজেই নিজের ভেতর সব লুকিয়ে রাখলেন।

-----------------------
 রাত একটা বাজে।
আজ আর তপুর জেগে থাকার নির্দেশ নেই। তপু নিশ্চিন্তে শান্তির ঘুম ঘুমাতে চায়। কিন্তু তপু বুঝতে পাড়ছে কেউ বাইরের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। পাকার উপরে অমসৃণ খালি পায়ের খস খস আওয়াজ হচ্ছে। আস্তে আস্তে ঘন হচ্ছে সে শব্দ। কেউ আসছে সন্তর্পণে, তপু ছাড়া বাকি সবার অজান্তে। আজ জানালা বন্ধ, এত ভয় হবার কথা না। তবুও তপু ঘামছে, সবাইকে বলতে চাচ্ছে চিৎকার করে, ‘সেই পাগলটা তার কাছে আসছে’, কিন্তু বলতে পারছেনা। সেই পাগল আকৃতির ছায়া মূর্তিটা বন্ধ দরজা জানালা ভেদ করে চলে আসছে তপুর খুব কাছে। তপুর পুরো শরীরটা অস্থির। সে ছুটে পালাতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছেনা। এখন কেন যেন তার খুব বেশি ভয় হচ্ছে না। একটা আবেগে সে পাগলটার দিকে চেয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে, এই লোকটা তার কত চেনা। ততোক্ষণে সে পাগলটা তার পাশে চলে এসেছে। সে তপুর পা ধরে টানতে শুরু করল, ঠিকে সেইভাবে যেভাবে সেইদিন অন্ধকারে সেই বাড়িটিতে টেনেছিল। এরপর সে তপুর হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল। কিন্তু তপু তো স্বপ্নের দেশে আছে। এমন দেশ থেকে সে যেতে চায়না চির নিদ্রার ঘুমের দেশে। কারণ তখনো যে সে জানতোনা তার অজানা বাবা অজানা বেশে অজানা দেশ থেকে তাকে বুকে টেনে নিতে এসেছে।

 ******************* সমাপ্ত *********************
 অন্ধকারে কে? (ভৌতিক গল্প)
লেখক পরিচিতি লেখকঃ তৌফিক মাসুদ
email: md.masud172@yahoo.com website: www.taufiquemasud.blogspot.com
Share:

পৃষ্ঠাসমূহ

Popular

Translate

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

Like Us